‘ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রায়গ্রামের সোমা রানী দাস পড়ছেন যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বলাকান্দর গ্রামের ঝুমরা খাতুন পড়াশোনা করেন যশোর সরকারি মহিলা কলেজে মাস্টার্সে। ঝিনাইদহ কিশোর চন্দ্র কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ছেন আরজুফা। প্রীতিলতা, আফরোজা পারভীন, সোমা রানী, সাহানা, বিথী, পিংকি, পুষ্প, বিজলী ও জলির মতো স্কুল ও কলেজপড়–য়া ৪৫ জন মেয়ে ঠিক করেছেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন।’ জাপানি নারী হিরোকো কোবাইসির অনুদানে এদের সহায়তা দিচ্ছে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড। হিরোকো কোবায়েসি ৮৮ বছর বয়সী জাপানী নারী। যিনি ইকেবানা’র (ফ্লাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট) শিক্ষক। তিনি ৪৫ বছর ধরে এই কাজটি করছেন। এছাড়া তিনি একজন ফটোগ্রাফার, তার ছবির মূল উপজীব্য নারী। ২০০৩ সাল থেকে যশোরের কালীগঞ্জ ও বোদা উপজেলার একশ’ মেয়ের পড়ালেখার জন্য তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
২০১৬ সালে কালীগঞ্জের ৪৫ জন মেয়ে শপথ নিয়েছেন, লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করবেন না। তারা আরো শপথ নিয়েছেন, তারা সমাজে বড় কিছু হয়ে সমাজের অসহায় গরিব মেধাবী মেয়েদের শিক্ষার জন্য সহযোগিতা করবেন। মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার এ উদ্যোগকে হাঙ্গার ফ্রি ওমেন স্কলারশিপ নামে একটি কর্মসূচি হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড চলমান রেখেছে।
হাঙ্গার ফ্রি ওমেন স্কলারশিপ দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হাফিজুর রহমান জানান, ২০০৩ সালে জাপানি নারী হিরোকো কোবাইসি বাংলাদেশে ঘুরতে আসেন। ওই সময় কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুর গ্রামের খাদিজা খাতুন টাকার
অভাবে এইচএসসি পরীক্ষার ফি না দিতে পারায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ খবর জানার পর জাপানী নারী হিরোকো কোবাইসি খাদিজা খাতুনের বাড়িতে যান এবং প্রতিশ্রুতি দেন অসহায় গরিব মেধাবী মেয়েদের তিনি শিক্ষাবৃত্তি দেবেন। এরপর শুরু। প্রতি বছর তিনি কালীগঞ্জ উপজেলার ৪৫ জনকে স্কুল ও কলেজপর্যায়ে টাকা দিয়ে আসছেন।
হাফিজুর রহমান আরো জানান, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কর্মীরা কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ও স্কুলে গিয়ে এসব গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করেন। ২০১৬-১৭ সালে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে ঝুমুরা খাতুন, আরজুফা খাতুন, প্রীতিলতা বিশ্বাস, আফরোজা পারভীন, সাহানা খাতুন, সোমা রানী, বীথি খাতুন, পিংকি খাতুন, পুষ্প বিশ্বাস, জলি খাতুন, বিজলী খাতুন, সুমি খাতুন, অনামিকা সরকার, শিলা খাতুন, ফারজানা আক্তার, স্মৃতি বিশ্বাস, রহিমা খাতুন, নাসরিন খাতুন, শান্তনা ইয়াসমিন, মাধবী লতা বিশ্বাস, সোহাগী খাতুন, মালেকা খাতুন, শান্তনা খাতুন, আঁখি খাতুন, ফারাফি নুসরাতসহ ২৫ জন শিক্ষার্থী ও স্কুলপর্যায়ে বিনা খাতুন, সম্পা খাতুন, বৃষ্টি খাতুন, জিনিয়া খাতুন, কনিকা খাতুন, হাফিজা খাতুন, অর্পিতা খাতুন, তামান্না খাতুন, হিরা খাতুন, রূপালী খাতুন, নাজমিন খাতুন, মুক্তা খাতুন, শারমিন জানান, হোসনে আরা বর্ষা, রিমি খাতুন, শিউলি রানী, স্বপ্না বিশ্বাস, চামেলী খাতুন, মল্লিকা বিশ্বাস, নাসরিন আক্তারসহ ২০ জনকে এ টাকা দেয়া হচ্ছে। তিন মাস পরপর বৃত্তিপ্রাপ্ত মেয়েরা এক জায়গায় হন। তিন মাসের টাকা একবারে দেয়া হয় তাদের। শিক্ষাবৃত্তি দেয়ার পর সংগঠনের কর্মীরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন, বৃত্তির টাকা নিয়ে তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করছেন কিনা, ঠিকমতো স্কুল/কলেজে যাচ্ছে কিনা। তিনি আরো জানান, যেসব মেয়েকে শিক্ষাবৃত্তি দেয়া হয় তারা শপথ নেন লেখাপড়া শেষ না করা পর্যন্ত তারা বিয়ে করবেন না। এমনকি তারা স্বাবলম্বী হলে গরিব ও মেধাবী মেয়েদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করবেন।
জাপান থেকে প্রতি বছর মার্চ মাসে হিরোকো কোবাইসি আসেন এসব মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। হিরোকো কোবাইসি কেন মেয়েদের বৃত্তি দেন এই প্রসঙ্গে হাঙ্গার ফি ওয়ার্ল্ডের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আনজুমান আক্তার জানান, জাপানি এ নারী পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। ছোট বেলায় তিনি খুব গরিব পরিবারের সন্তান ছিলেন। অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যদি কখনো বড় কিছু হতে পারেন তাহলে তিনি গরিব মেধাবী মেয়েদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করবেন। সেই প্রতিজ্ঞা থেকে কোবাইসি এই শিক্ষা বৃত্তি দিচ্ছেন।
তিনি আরো জানান, এটি এখন আর শুধু বৃত্তি দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বৃত্তিপ্রাপ্ত মেয়েদের জীবনদর্শন, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, নিজের জীবনকে সুন্দর করার স্বপ্ন ইত্যাদি বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। হিরোকো কোবায়েসির মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের মানুষও এখন এই কর্মসূচি এগিয়ে নিতে মেয়েদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে এরই মধ্যে ১১ জন প্রতি বছর হাঙ্গার ফি ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যেতে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। তারা মেয়েদের পড়ালেখাসহ তাদের ভালো-মন্দ খোঁজখবর নিচ্ছেন, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি আশা করেন এমন একটি প্রক্রিয়া বৃত্তিপ্রাপ্ত মেয়েদের পড়ালেখা শেষ করা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং একটি সুন্দর জীবন গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।