৪৫ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। একসময় তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন বিশ্বের কোনো কোনো দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বা রোল মডেল হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এখন তা হরহামেশায় আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যেখানে রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্যম আয়ের। সেখানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যে লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি (এলডিসি) বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। অবশ্য তারও একটি যৌক্তিকতা রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে, একটি ধাপে কোনো একটি দেশ কতটুকু টেকসই হবে, সেটি দেখার জন্য পরবর্তী তিন বছর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। আর সম্প্রতি এ তথ্য একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড)। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৬ প্রকাশকালে বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা— এ তিন সূচকের মধ্যে কমপক্ষে দুটি সূচকে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে হয়। এর পর আরো তিন বছর অর্থাত্ ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্জনগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। পরে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়ে আসার বিষয়ে অনুমোদন পেতে হবে। ২০১৪ সালে এলডিসি থেকে বের হলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এলডিসি হিসেবে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, বাংলাদেশের জন্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। সিপিডি থেকে আরো জানা যায়, বিশ্বের বহু দেশ এখন এলডিসি থেকে বের হয়ে যেতে চাইছে। এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। তার একটি হলো, এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি ছিল, তা পায়নি। এতে তারা হতাশ হয়েছে। অন্যদিকে যেসব দেশ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাদের মধ্যেও অর্থনৈতিক অবসাদ (ফ্যাটিং) এসেছে। দ্বিতীয়টি হলো, এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে কৃতিত্ব নিতে চাইছে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে। এর পরের স্তর হচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশ। এই স্তরে পৌঁছতে হলে বর্তমানের মাথাপিছু আয়কে দ্রুত ৪ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিশ্বের ১৬টি দেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, ভুটান, জিবুতি, গিনি, কিরিবাতি, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল, সাওতুমে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব তিমুর, টুভালু, ভানুয়াতু, ইয়েমেন প্রভৃতি। এগুলোর মধ্য থেকে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, জিবুতি, লাওস, মিয়ানমার ও ইয়েমেন ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। অন্যরা আরো আগেই এ মর্যাদা অর্জন করবে বলে মনে করছে তারা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছরই জাতিসংঘ বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত— এ তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকের ভিত্তিতে এ ভাগ করা হয়েছে। সে হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে সর্বমোট ৪৮টি দেশ। প্রতি তিন বছর অন্তর এ তালিকা পর্যালোচনা করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) নামের একটি সংস্থা। অথচ ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র মাইনাস ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এক বছর পরই অর্থাত্ ১৯৭৩ সালে সেই প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশে, আর বর্তমানে অর্থাত্ ২০১৬ সালে সেই প্রবৃদ্ধি এখন ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আর সেই সময় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়েছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার, আর ৪৫ বছর পরে এসে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেই বাজেটের আকার বাড়তে বাড়তে এখন তা ৩ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে বিজয়ের ৪৫ বছর পরে এই জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, যা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। এখন সামনে তাকালে উন্নয়নের চিত্র চারপাশে খুবই দৃশ্যমান। এ উন্নয়নের কিছু সূচক হলো, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার, দারিদ্র্যের হার কমে এখন ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলার, রফতানি আয় ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, চাল উৎপাদন ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন, সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ, গড় আয়ু ৭০ বছরের উপরে, ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ ইত্যাদি। শিক্ষা খাতেও বাংলাদেশের অর্জন আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, যেখানে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ নারীই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। এখন নারীদের প্রায় ৫৭ ভাগই শিক্ষিত। দেশের নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৮ হাজার, এখন তা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেড়েছে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র চারটি, আর এখন হয়েছে ৩৮টি। তখন দেশে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, কিন্তু এখন তা ৯৬টি। স্বাস্থ্যসেবায় ৯৮ ভাগই দেশীয় ওষুধ দিয়ে করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এখন বাংলাদেশের ওষুধ বিদেশে রফতানিও করা হচ্ছে। যোগাযোগ, বিদ্যুত্, ডিজিটাল প্রযুক্তি ইত্যাদি সেবা এখন প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরোতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলো খুবই দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আইনের চোখে সবাইকে সমান হিসেবে বিবেচনা করে যথাযথ আইনের প্রয়োগে দৃষ্টান্তমূলক বিচারকার্য সম্পন্ন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা। তার পর অর্থনৈতিক বিষয়ে শৃঙ্খলা আনা। তারই অংশ হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আয় কাজে লাগানো, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রফতানি পণ্যের তালিকা দীর্ঘ করা এবং সেগুলোকে আরো বহুমুখী করতে সহায়তা করা। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে আমাদের দেশীয় পণ্যের কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেসঙ্গে তৈরি পোশাক খাতে জিএসপি সুবিধা আদায়ে আরো তত্পর হতে হবে। অন্যদিকে ২০০০-১৫ পর্যন্ত জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) যে আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়েছে, ঠিক একইভাবে ২০১৫-৩০ পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ বাংলাদেশ এরই মধ্যে আর্থিক খাতে যে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে আশা জাগিয়েছে, সেখানে নিরাশ হওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং তা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার