অটিস্টিকদের অধিকতর অংশগ্রহণ

সাধারণত অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তির কথা বার্তা বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈকল্য ও অসঙ্গতি দেখা যায়। দেরিতে কথা বলা, জবান বা বোল বা বাক প্রভৃতিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। খেলাধুলায় অনীহা কিংবা নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা থাকে। আচরণের দিক দিয়ে এদের মধ্যে অঙ্গের যেমন—হাত, আঙুল, মাথা প্রভৃতির অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা দেয়। মূলত অটিজম একটি জটিল বিকাশজনিত বৈকল্য। এর ফলে ব্যক্তির সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা, আবেগীয় পেশী বা সেন্সরি সঞ্চালনে সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রতি ৮৮ জনে একজন অটিস্টিক। ১৯৯০ সালে এদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রতি দশ হাজারে একজন ছিল। ২০০৯ সালে ১৫০ জনে একজন এবং এরপর প্রতি এক’শ জনে একজন অটিস্টিক ছিল। আসলে এদের উপস্থিতি জাতি ধর্ম বর্ণ মিলে সব দেশে লক্ষ্য করা যায়। বলা হচ্ছে অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর বিশাল সামর্থ্য আছে। স্বাভাবিক চাকরির সুযোগ করে দিলে তারাও সমাজে সমান অবদান রাখতে পারে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও মানুষের সম্পৃক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, চাকরিদাতা, বেসরকারি সংস্থাসহ সকলকেই তৈরি হতে হবে। অটিস্টিক জনগোষ্ঠীকে বিশ্বের মূলধারার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সেবা দিয়ে কর্মোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশ্বের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহত্ ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে। বিশ্বে অটিজম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সহযোগিতার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতের উদ্যোগ, অটিস্টিকদের জীবনের পুরোটা সময় সেবা নিশ্চিতের উদ্যোগ, দেশভিত্তিক বহু খাত ও স্তরভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, টেকসই ও সাশ্রয়ী কর্মকৌশল বাস্তবায়ন এবং বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক সেবাসহ প্রতিটি খাতে অটিস্টিকদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশে অটিস্টিকদের জন্য কাজ করা খুব সহজ নয়। এর জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। এসব দেশে অটিজম মোকাবিলায় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও সীমিত সেবা, সেবাদানকারীদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।

অটিজম আক্রান্ত শিশুরাও এই সমাজের অংশ এবং তাদেরও সব পর্যায়ে সমান অধিকার থাকার বিষয়টি যত বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল। অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তির মধ্যে যেসব সামাজিক দক্ষতা, সহানুভূতি, যোগাযোগ এবং আচরণের বৈকল্য দেখা যায় সেগুলো একে অন্যের থেকে ভিন্ন হয়। অর্থাত্ দুজন অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তির মধ্যে একই লক্ষণ পাওয়া গেলেও তাদের মধ্যে আচরণিক ও দক্ষতার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। এজন্য মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে, তার সন্তানের মধ্যে অটিজম সংক্রান্ত লক্ষণের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান সে বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য শিশুর মধ্যে নাও থাকতে পারে। তবে অন্য শিশুটিও অটিস্টিক। মা-বাবার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশী অন্যদেরও এই ধরনের কথা মনে রাখতে হবে। ২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অটিজম সচেতনতা ও সেবা নিয়ে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়।

বর্তমানে অটিজমবিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং কারিগরি নির্দেশক কমিটির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে অটিজম সচেতনতা, দ্রুত চিহ্নিতকরণ, সেবা ও পুনর্বাসনে কাজ চলছে। এজন্য ১৩টি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশে অটিজম সচেতনতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অটিস্টিক শিশুর মা-বাবার ক্ষমতায়ন, নীতি ও আইনি কাঠামো চিহ্নিতকরণ, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও অভিভাবকের সমন্বয়, দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলা ও অধিকতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সামর্থ্য বাড়ানো, প্রচলিত জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণে অটিজমকে সম্পৃক্ত করা, দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও গবেষণা এই ৭টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছয় স্তরের কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ চলছে, যেখানে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ এবং অটিস্টিকদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, চিকিত্সক, সেবাদানকারী ও মা-বাবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সমাজের নির্যাতিত, দুর্বল, সংখ্যালঘু ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের দিশারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করে তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার মতোই অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সারা বিশ্বে একযোগে কাজ করছেন প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবন মানের উন্নয়নে।

অটিজমের প্রসঙ্গ এলেই যার কথা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তিনি অটিজম বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি জাতিসংঘের ‘অটিজম মোকাবিলা : এসডিজির আলোকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কৌশল’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে ও প্রচেষ্টায় অটিস্টিকদের সেবা ও পুনর্বাসনে নিরলস কাজ করছে বাংলাদেশ। তিনি ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়ুবিক জটিলতা সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পেয়েছে। মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকস-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত আছেন। তাঁর উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক।