রূপ নিচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ

প্রত্যাশার চেয়ে অগ্রগতি কম। জাতিসংঘের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে বিশেষায়িত সংস্থা আইটিইউয়ের ২০১৬ সালের আইসিটি উন্নয়ন সূচকে (আইডিআই) ১৭৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫তম। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ৩০ নম্বরে। এ অঞ্চলে বাংলাদেশের পরের অবস্থানে আছে পাকিস্তান, কিরিবাতি, সলোমন আইল্যান্ডস ও আফগানিস্তান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী অগ্রগতি না হলেও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন আর দূরের কোনো স্বপ্ন নয়। বেসরকারি হিসাবে দেশ থেকে বছরে ৭০ কোটি ডলারের সফওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আজ জনপ্রিয় স্লোগান হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার আলোচনা এখন বিশ্বজুড়ে। টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতের উন্নয়নে সরকারের যে ব্যাপক পরিকল্পনা তা বহির্বিশ্বেও প্রশংসিত। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে এখনো পিছিয়ে রয়েছে, সেটাই এ খাতে জড়িত সব পক্ষের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

কত দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ—এ প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকার চরম বিপর্যয় ঘটে গেলেও জাতীয় তথ্যভাণ্ডারে রক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য হারানোর ভয় আর নেই। দেশের সবচেয়ে কম দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে যশোরকে চিহ্নিত করে সম্প্রতি সেখানে ‘ইনফো-সরকার’ প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার। সেখানে ব্যাকআপ হিসেবে জাতীয় তথ্যভাণ্ডারের সব তথ্য জমা থাকছে। এ ধরনের ব্যবস্থা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম।

কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক স্থাপনের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে। এ পার্ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, কলসেন্টার এবং টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে তৈরি হবে বিশ্বমানের পণ্য। দেশীয় সফটওয়্যার দিয়েই চলবে ব্যাংক, বীমা, কলকারখানা, অফিস-আদালত। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, কমবে মেধাপাচার। বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সম্প্রতি জানিয়েছেন, সারা দেশে ২৮টি আইসিটি পার্ক নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে একটি হবে চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়ায় ১৪ একর জায়গার ওপর। সিলেটে হাইটেক পার্ক নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু হওয়ার পথে। কেরানীগঞ্জের জাজিরা মৌজায় স্থাপন করা হবে আরেকটি হাইটেক আইসিটি পার্ক। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে তিন একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

দেশের ৬৪ জেলা ও ৪৮৭টি উপজেলার আঠারো হাজার ১৩০টি সরকারি দপ্তরে ফাইবার অপটিকের ইন্টারনেট যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শেষ। ৮০০টি সরকারি অফিসে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যয়বহুল সফর এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রাজধানীতে নিজের অফিসে বসেই বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করতে পারছেন।

এ ছাড়া শুরু হতে যাচ্ছে ‘ইনফো সরকার-৩’ প্রকল্প। এর মাধমে দেশের দুই হাজার ৬০০ ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) ২০১৮ সালের মধ্যে ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্ক পৌঁছে যাবে। ফলে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো (ইউডিসি) উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা পাবে। ইউডিসির উল্লেখযোগ্য সরকারি সেবাগুলো হলো জমির পর্চা, জীবন বীমা, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, সরকারি ফরম, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ভিজিএফ-ভিজিডি তালিকা, নাগরিক সনদ, কৃষি তথ্য, স্বাস্থ্য পরামর্শ ইত্যাদি। বেসরকারি সেবার মধ্যে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ই-মেইল, চাকরির তথ্য, ভিসা আবেদন ও ট্র্যাকিং, ভিডিও কনফারেন্সিং ইত্যাদি ।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী তাদের চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, ‘লেভারেজিং ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস টেকনোলজিস ফর গ্রোথ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স’। ৫৭২ কোটি টাকার এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৪ হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। উদ্দেশ্য, আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান এবং এ খাতের রপ্তানি বহুমুখী করা। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা। কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক উন্নয়নে সহযোগিতার জন্য ২২৫ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। ২৪০ কোটি টাকার যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে, শেষ হওয়ার কথা ২০১৭ সালে। আত্মকর্মসংস্থান ও অনলাইন আউটসোর্সিং বৃদ্ধিতে ১৮০ কোটি টাকার ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। সেটিও চলতি বছর শেষ হওয়ার কথা। সারা দেশে দুই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও ভাষা শিক্ষা ল্যাব স্থাপন এবং এক হাজার শিক্ষককে ৯টি ভাষা শিক্ষা দিতে ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৫ সালের শুরুতে। সিলেট হাইটেক পার্ক প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ডিসেম্বরে, ব্যয় হবে ২২৭ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের পরিচালক ব্যারিস্টার মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, নৌবাহিনী এ প্রকল্পে সহায়তা দিতে যাচ্ছে। এক হাজার ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ন্যাশনাল ফোর টিয়ার ডাটা সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের কাজে ২০১৬ সালেই শেষ হওয়ার কথা। ২৮১ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনে দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প গত জুলাইয়ে শুরু হয়েছে। শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের জুনে। ২৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট ইআরপি প্রকল্প শুরু হয়েছে গত জুনে। শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের জুনে।

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ মহাকাশে উেক্ষপণ করা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ৫৭তম সদস্য হিসেবে মহাকাশে নাম লেখাতে যাচ্ছে। এ জন্য দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন হচ্ছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়। টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলছে, দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে এ  স্যাটেলাইট। এর মাধ্যমে বিদেশি স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরতা দূর হবে এবং সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই  দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল এসএমডাব্লিউ-৫-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখন পটুয়াখালীর ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে ঢাকায় সংযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে সেটি চালু হবে। ৫৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ওই সাবমেরিন কেবল থেকে প্রথম পর্যায়ে পাওয়া যাবে আরো ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ। দেশে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ৩০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ । এসএমডাব্লিউ-৪-এর ক্যাপাসিটি এখন ৩০০ জিবিপিএস। এর মধ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে ১৭৬ জিবিপিএস। বাকিটা আসছে ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবলের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে। এ বছরই  ফোরজি ও এলটিই তরঙ্গ নিলামের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে (এসওএফ) জমা হওয়া প্রায় এক হাজার কোটি টাকা কোন কাজে লাগানো হবে তা শিগগিরই  নির্ধারণ করা হবে। পরিকল্পনা রয়েছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার টাওয়ারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হবে তৃতীয় পক্ষকে, যার সঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সম্পর্ক থাকবে না। গতকাল শনিবার চালু হয়েছে ইন্টারনেটজগতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডোমেইন (আইডিএন) ডটবাংলা (.বাংলা)। এমএনপি বা নম্বর না পাল্টে মোবাইল ফোন অপারেটর বদলের সুবিধা চালুর প্রক্রিয়া চলছে। মোবাইল হ্যান্ডসেটের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি নম্বর নিবন্ধনের কাজও শিগগির শুরু হতে পারে।

বিশ্বে টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের তালিকা দীর্ঘ। এ খাতের বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বলছেন, ২০০৯ সালে সরকারি নীতি ও প্রচেষ্টায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের যাত্রা তাঁদের এ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে নৈশভোজ অনুষ্ঠানে চীনভিত্তিক টেলিযোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েইয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তিনটি কারণে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো হলো জনঘনত্ব, তরুণদের দ্রুত দক্ষতা অর্জন এবং এ খাতের উন্নয়নে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প।

দেশে সফটওয়্যার ও তথ্য-প্রযুক্তি সেবা খাতের বাণিজ্যিক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপিত তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে। সেগুলো হলো সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষা তথা মানবসম্পদের ডিজিটাল রূপান্তর এবং জীবনধারা ডিজিটাল উপায়ে তৈরি হওয়া। বর্তমান সময়ের বিবেচনায় এ দেশের জনগণ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যেভাবে গ্রহণ করেছে তা অসাধারণ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ জনপ্রিয় স্লোগান হিসেবে গৃহীত হয়েছে। দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকসংখ্যা সাত বছর আগে ছিল মাত্র ১২ লাখ। এখন ছয় কোটির ওপরে। তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তারা কম্পিউটারের জন্য অপেক্ষা করেনি, হাতের কাছে সহজলভ্য যে প্রযুক্তি পেয়েছে তা-ই কাজে লাগিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। দেশে ফেসবুকের গ্রাহক এখন দুই কোটির ওপরে। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন করে ফেসবুকের গ্রাহক বাড়ছে। মোবাইল ফোনে লেনদেন হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। আর্থিক এ লেনদেনের জন্য প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার ওপর নির্ভর না থেকে জনগণ ডিজিটাল পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। পৃথিবীতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ এখন এক নম্বরে।

২০০৮ সালে দেশ থেকে দুই কোটি ৬০ লাখ ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি হয়েছে। এখন সরকারি হিসাবে তা ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। বেসরকারি হিসাবে তা আরো বেশি, ৭০ কোটি ডলার।

মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে জনগণকে নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। জনগণ প্রযুক্তি আর ইন্টারনেট পেলেই এ লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক উদ্যোগ রয়েছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ইউডিসি স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। স্কুলগুলোতে ডিজিটাল ক্লাসরুম, কম্পিউটার ল্যাব ও ভাষাশিক্ষা ল্যাব স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এর সুফল এখনো জনগণের কাছে পৌঁছেনি। গত সাত বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে আরো অনেক বেশি প্রত্যাশা করেছিলাম আমরা। এখনো সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ও দেখি না যে কাগজবিহীন হয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোর তথ্য এখনো ডিজিটাল হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে ছোট ছোট চিমটি কাটা শুরু হয়েছে; কিন্তু এর জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই, সমন্বয় নেই। অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বিটিআরসি যে যার মতো করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ’

বিশিষ্ট এই তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, “ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনের পথে প্রধান সমস্যা সরকারের প্রশাসনিক জায়গায়। জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্রে যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে আমাদের বহুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। ২০০৭ সালে আমরা বলেছিলাম, আমাদের ইন্টারনেট সভ্যতায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু এ সভ্যতায় পৌঁছানোর জন্য সবার কাছে ইন্টারনেট যেতে হবে, ইন্টারনেটের গতি বাড়াতে হবে। আমরা এখনো কেন ‘ফোরজি’ পাচ্ছি না? ভিডিও ডাউনলোডের স্পিড কেন পাচ্ছি না? সরকার ব্যান্ডউইডথের দাম কমিয়েছে। কিন্তু ভোক্তারা সে সুফল পাচ্ছে না। টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বিটিআরসির এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই। এর ফলে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক বিজনেসও সেভাবে বাড়ছে না। সরকারের নীতিমালা অনুসারে, এখন দেড় মেগাবাইট পারসেকেন্ড গতির ইন্টারনেট পাওয়ার কথা। উন্নত দেশগুলোতে এখন ইন্টারনেটের গতি গিগাবাইট হিসাবে চলে।   কিন্তু আমরা পড়ে আছি কিলোবাইটেই। সরকারি উদ্যোগে দেশের সব এলাকায় ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ কাজ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু নেটওয়ার্ক বাড়ি বাড়ি পৌঁছানো দরকার। ”

সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে আউটসোর্সিং, রিসার্চের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইসিটি পার্ক স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এ জন্য আগে প্রয়োজন উচ্চগতির সহজলভ্য ইন্টারনেট।

গ্রামীণফোনের সিএমও ইয়াসির আজমান বলেন, “ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। এর মূলে আছে কানেক্টিভিটি, ইন্টারনেট, বিশেষ করে মোবাইল ইন্টারনেট। সরকারও ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। তবে মানসম্মত শিক্ষা, তথ্য জানার অধিকার ও সুযোগ এবং উপযুক্ত অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততার কারণে উন্নত দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। এ ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করতে পারলে দেশের উন্নতি প্রকৃতপক্ষেই পরিলক্ষিত হবে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ পরিণত করার জন্য এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। ”

ইয়াসির আজমান বলেন, ‘দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ব্যবসায়িক সাফল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। দেশের উন্নয়নের ধারাও বজায় থাকছে। ডিজিটাল বা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যাপক সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে গতানুগতিক পদ্ধতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের গ্রাহকরা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে অনেক সহজেই। সময় কিংবা স্থানভেদে ডিজিটাল সেবা কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে নেই। এই নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে প্রয়োজন দীর্ঘদেয়াদি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ। ডিজিটাল খাতে দেশে অনেক অগ্রগতি হলেও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমরা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। তাই কনটেন্ট ও বাণিজ্যিক সেবার উন্নয়নে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। আবার এই পিছিয়ে থাকাই এ খাতে জড়িত সব পক্ষের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ’

ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বা এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হক সিদ্দিকী বলেন, ‘দেশে ফাইবার অপটিকের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজ শুরুর সময় সরকারের ধারণা ছিল মোবাইল ফোন অপারেটররা অনেক কাজ এগিয়ে রেখেছে। আমরা বাকিটুকু করব। কিন্তু বাস্তবে কাজ এগিয়ে ছিল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মাত্র। ইনফো সরকার-১ প্রকল্পে আমাদের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলাকে ঢাকার প্রধান সরকারি অফিসগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ইনফো সরকার-২ প্রকল্পে সরকারের ১৮ হাজার কোর অফিসকে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এখন আসছে ইনফো সরকার-৩ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক পৌছে যাবে। এর মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়ন এক গিগাবাইট ব্যান্ডউইডথ সাপোর্ট পাবে। ’

মইনুল হক সিদ্দিকী বলেন, আগামী বছর বিশ্বে ইন্টারনেটের মার্কেট হবে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারের। প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে সংগতি রাখতে দেশেও উচ্চগতির ইন্টারনেটের চাহিদা অনেক বাড়বে। দেশেই এখন ইলেকট্রিসিটির জন্য স্মার্ট মিটার তৈরি হতে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির যুগ আসছে। এতে ভিডিও দেখা যাবে থ্রিডির মতো। এসব সেবা নিতে ব্যান্ডউইডথ আরো বেশি লাগবে। এর জন্য এনটিটিএন অপারেটরদের আরো সক্ষম হতে হবে। দেশে ফাইবার অপটিকের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক যত বাড়বে মোবাইল ফোন অপারেটরদের ব্যয়ও তত কমবে। ইতিমধ্যে তারা এর সুফল পেতে শুরু করেছে। ইনফো সরকার-৩-এর পর আসবে ১০০ কোটি ডলারের ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট ইনফো সরকার-৪।

মইনুল হক সিদ্দিকী এনটিটিএন অপারেটরদের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলেন, ‘প্রথম দিকে এনটিটিএন অপারেটরদের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন প্রয়োগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি তৎপর ছিল না। এ কারণে লাইসেন্সবহির্ভূত কিছু প্রতিষ্ঠান সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। সরকার ফাইবার অপটিক আমদানির ক্ষেত্রেও প্রতিবছর শুল্ক বাড়িয়েছে। এসব টানাপড়েনের কারণে আমরা যতটুকু কাজ করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি করতে পারতাম এবং তাতে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজ আরো সহজ হতো। ’