চালু হলো ডটবাংলা ডোমেইন

ইন্টারনেট জগতে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের এবং বাংলা ভাষার স্বীকৃতি হিসেবে ডটবাংলা (.বাংলা) ডোমেইনের যাত্রা শুরু হলো। গতকাল শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডটবাংলা ডোমেইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় বলেন, ‘ডটবাংলা কেবল একটি ডোমেইনের নাম নয়, এটি আজ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ডটবাংলার বিজয় ভাষাশহীদদের বিজয়। এ বিজয় মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের বিজয়। ’

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলা ডোমেইন চালুর ফলে আইসিটি খাতে ব্যবসার আরো প্রসার ঘটবে। যাঁরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণার সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরাও ডটবাংলা ডোমেইন ব্যবহার করতে পারবেন। ’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, টেলিযোগাযোগ সচিব মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, বিটিসিএলের এমডি মাহফুজ উদ্দিন আহমদসহ ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা।

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ পাঁচ বছর ঝুলে থাকার পর গত ৫ অক্টোবর ইন্টারনেট করপোরেশন অব অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইসিএএনএন) বাংলাদেশকে ডটবাংলা ডোমেইন চালুর অনুমোদন দেয়।

এ বিষয়ে ওই দিন তারানা হালিম তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, “অবশেষে ‘ডটবাংলা ডোমেইন’ বাংলাদেশের অনুকূলে অনুমোদিত। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরেকটি কাজ সম্পন্ন হলো। অনেক চেষ্টার পর ডটবাংলা ডোমেইন বাংলাদেশের অনুকূলে আইসিএএনএন কর্তৃক বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। উক্ত ডোমেইনটি পাওয়ার জন্য সিয়েরা লিওনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। বাংলাদেশের পক্ষে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের হয়ে আইসিএএনএনের কাছে এই তথ্য তুলে ধরি যে, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ; যে দেশের মানুষ মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে। ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই এ ভাষার ওপর বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সর্বাগ্রে। ডটবাংলা ডোমেইনটি বাংলাদেশের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদানের জন্য আমি আইসিএএনএনের কাছে একাধিক অনুরোধপত্র প্রদান করেছি। আজ আইসিএএনএন কর্তৃক ডটবাংলা ডোমেইনটি বাংলাদেশের অনুকূলে বরাদ্দপ্রাপ্ত হওয়ায় বাংলা ভাষার এই অর্জন-মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ”

এদিকে কারিগরি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা এবং ঘোষণা থাকার পরও প্রয়োজনীয় অনুমোদন না পাওয়ায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ডটবাংলা ডোমেইন চালু করতে পারেনি বাংলাদেশ। গত ১৮ অক্টোবর তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এটি চালু হবে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এই ডোমেইনটি হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ডোমেইন। ডটবিডি (ইংরেজিতে লেখা) নামে আরেকটি ডোমেইন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। এর সক্রিয় নিবন্ধন সংখ্যা ৩৬ হাজার ৫০০। ইন্টারনেট অ্যাসাইনড নাম্বারস অথরিটির (আইএএনএ) তালিকায় বাংলা ভাষায় লেখা ডোমেইন হিসেবে ডটবাংলা হচ্ছে দ্বিতীয়। ‘ডটভারত’ নামে আরেকটি বাংলায় লেখা ডোমেইন ওই তালিকায় আগেই স্থান পেয়েছে।

ভারতে হিন্দি, উর্দু, তেলেগু, গুজরাটি, পাঞ্জাবি ও তামিল ভাষায়ও ডোমেইন রয়েছে। ডটভারত ডোমেইনটি নিবন্ধন করা হয় ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইসিএএনএনের কাছে আবেদনের পর ২০১১ সালে ডটবাংলা ডোমেইনটির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন এবং পরের বছর আইএএনএর অনুমোদন পায়। ভারতও ২০১০ সালে বাংলাদেশের পাশাপাশি এ ডোমেইনটির অধিকার পেতে আবেদন করে। সব দিক বিবেচনা করে আইসিএএনএন তখন ডোমেইনটি বাংলাদেশকেই বরাদ্দ দেয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরো জানান, পাঁচ বছর আগে ডটবাংলা ডোমেইনটি নিবন্ধন পেলেও এটি কার্যকর করাতে দেরি হওয়ায় এর অধিকার হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ। ডোমেইনটি কে নিয়ন্ত্রণ করবে—বিটিসিএল, না বিটিআরসি—এ প্রশ্নেই কেটে যায় দীর্ঘদিন। ডোমেইনটি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন না করা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠার পর গত জুন মাসের দিকে আবারও এর অধিকার বহাল রাখতে তৎপর হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এর আগে গত বছরের ১৯ মে তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলকের সঙ্গে দেখা করে ডটবাংলার গুরুত্ব, অনলাইনে বাংলার অবস্থান, বাণিজ্যিক বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন আইকানের পরিচালক (সিকিউরিটি ও সার্ভেইল্যান্স) জন এল ক্রেইন ও এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনের পার্টনার এনগেজমেন্ট ম্যানেজার চম্পিকা বিজয়েতুঙ্গা। বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটরস গ্রুপের (বিডিনগ) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ সাবির ওই প্রতিনিধিদলে ছিলেন।

মূলত ওই বৈঠকের পরই ডটবাংলা বাস্তবায়নের গতি পায়। মন্ত্রণালয়, বিটিসিএল ও বিটিআরিসির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বিটিসিএলই এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ডমেস্টিক নেটওয়ার্কিং কো-অর্ডিনেশন কমিটির (ডিএনসিসি) সভায় বিটিসিএলকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর বিটিসিএল ডটবাংলার জন্য একটি ডিএনএস সার্ভার স্থাপনের কাজ শুরু করে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে বিটিসিএলকে সহায়তা করে।

খরচ কেমন পড়বে : ডটবাংলায় ডোমেইন পাওয়া যাবে এক হাজার টাকায়। এই টাকা বছরপ্রতি ৫০০ টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি হিসেবে এককালীন পরিশোধ ধরা হবে। অর্থাৎ ডোমেইন নিতে হলে প্রথমেই দুই বছরের ফি দিতে হবে।

এতে বিশেষ শব্দের ডোমেইনের ক্ষেত্রে ফি ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এই ডোমেইনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, কম্পানি ও সংস্থাকে।

মেয়াদ শেষে ডোমেইনের নবায়ন ফি দিতে হবে বছরপ্রতি ৫০০ টাকা। মেয়াদ শেষে নবায়নের ক্ষেত্রে এক মাস ও তিন মাস সময়ের বিলম্বে ৫০০ ও এক হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। আর তিন মাসের মধ্যে নবায়ন না করলে ডোমেইন হারাতে হবে।

কেউ ডোমেইন বিক্রি করলে তাতে মালিকানা পরিবর্তনের ফি রাখা হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। ডোমেইন কেনার সময় যদি কেউ একসঙ্গে পাঁচ বছর ও ১০ বছরের ফি পরিশোধ করে সে ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২০ ও ৩০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যাবে।

ডটবাংলা পেতে গ্রাহককে যেতে হবে বিটিসিএলের ওয়েবসাইটে (www.btcl.com.bd) বা এর কার্যালয়ে। ওয়েবসাইটে গিয়ে সহজেই অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও ফরম পূরণ করে ডটবাংলা পাওয়া যাবে। এতে ডোমেইন রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম ও শর্ত দেওয়া রয়েছে। বিটিসিএলের কার্যালয়ে সরাসরি গিয়েও এই সেবা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া কল সেন্টার নম্বর ১৬৪০২-এ কল করে সাহায্য নেওয়া যাবে।