বছর শেষে নতুন রেকর্ড

নতুন ইতিহাস গড়ে পুরনো বছরের শুভ সমাপ্তি টানল চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরে ২০১৬ সালে হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৩ লক্ষাধিক কনটেইনার। ১২৮ বছরের ইতিহাসে এটিই এক বছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগে ২০১৫ সালে প্রায় সাড়ে ২০ লাখ কনটেইনার ওঠানামার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো টু মিলিয়নস ক্লাবে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম বন্দর। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত বছরে কার্গো পণ্য ওঠানামার ক্ষেত্রেও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গতবারে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি ৯২ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডল করলেও এবার তারা হ্যান্ডলিং করেছে প্রায় সাত কোটি টন। অবশ্য গত বছরে এই বন্দরে জাহাজও ভিড়েছে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘নৌবাণিজ্য ক্রমশ বাড়তে থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানি-রফতানির হারও বাড়ছে। বর্ধিত এ বাণিজ্য সামাল দিতে হলে বন্দরের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। তাই বে-টার্মিনালসহ নতুন আরও কয়েকটি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার

অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর ২০১৬ সালেই সর্বোচ্চ সংখ্যক কনটেইনার হ্যান্ডল করেছি আমরা। কার্গো পণ্যও ওঠানামা হয়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে দ্রুততম সময়ে। বাড়াতে হবে যন্ত্রপাতির সংখ্যাও।’

বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ১৭ লাখ ৩১ হাজার ২১৯ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু ২০১৫ সালে বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। যা বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবার ২০১৫ সালের কীর্তিকেও ছাড়িয়ে গেছে বন্দর। কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ টিইইউএস। গতবারের তুলনায় এবারে প্রবৃদ্ধির পরিমাণও ছয় শতাংশের বেশি। কার্গো পণ্য হ্যান্ডলের ক্ষেত্রেও গতবারের তুলনায় এবার বেশি পণ্য ওঠানামা করতে পেরেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালে পাঁচ কোটি ৯২ লাখ টন পণ্য ওঠানামা হলেও ২০১৬ সালে হয়েছে প্রায় সাত কোটি টন। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশেরও বেশি।

নতুন বছরে কনটেইনার ওঠানামার পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই কর্ণফুলীর প্রবেশমুখে অচিরেই বে-টার্মিনাল নির্মাণ করার তোড়জোড় চলছে। নতুন এ টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এর সুবাদে দৈনিক যাতায়াত করতে পারবে পাঁচ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজও। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে একদিনে সর্বোচ্চ হ্যান্ডল করতে পারছে এক হাজার ৭০০ কনটেইনারবাহী জাহাজ। এ বন্দরে ৯ দশমিক ৫০ মিটারের অধিক গভীরতার কোনো জাহাজ নোঙর করতে পারছে না এখন। কিন্তু বে-টার্মিনাল হলে বন্দরে ঢুকতে পারবে ১৪ মিটার গভীর ড্রাফটের জাহাজও। এ জন্য কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ৯০৭ একর জায়গা চিহ্নিত করে নতুন টার্মিনালের জন্য চলছে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তুতি।

নতুন বছরে লালদিয়াতে করা হবে বাল্ক পণ্যের কার্গো। কেনা হবে শতকোটি টাকার সরঞ্জামও। জেটিতে নিরাপত্তা জোরদার করতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে গেইট এক্সেস কন্ট্রোল প্রকল্প। স্থাপন করা হচ্ছে সাত শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরাও। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে নতুন বছরে চট্টগ্রাম বন্দর আরও এগিয়ে যাবে বলে মনে করে এর ব্যবহারকারীরা।

পোর্ট ইউজার্স ফোরামের চেয়ারম্যান ও চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহাবুবুল আলম বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সামাল দিতে হলে বাড়াতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা। উন্নয়নের নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। আশা করছি নতুন বছরে পরিকল্পনা অনুযায়ী ইক্যুইপমেন্ট কিনবে চট্টগ্রাম বন্দর। এটি করা গেলেই বাড়বে বন্দরের উৎপাদনশীলতা।’

চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১৬ সালে জাহাজও এসেছে রেকর্ড পরিমাণ। নভেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৭৬৪টি জাহাজ নোঙর করেছে দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরে। এর মধ্যে খোলা পণ্যের জাহাজ ছিল এক হাজার ৫৯৯টি। আর কনটেইনার বোঝাই জাহাজ ছিল এক হাজার ১৬৫টি। ডিসেম্বরে আসা-যাওয়া করা জাহাজ যুক্ত হলে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে গত বছরের রেকর্ডকেও। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসে দুই হাজার ৪১০টি। ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে জাহাজ এসেছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৩০৮, ২ হাজার ৭৬ ও ২ হাজার ১৫৬টি।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই অর্থনীতির স্বর্ণদুয়ার বলা হয় চট্টগ্রাম বন্দরকে।