চীনকে ছাড়িয়ে অন্য সম্ভাবনায়

চীনের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখে ২০ থেকে ৩০ বছর আগে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা দেশটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই সম্ভাবনা এখন তারা বাংলাদেশে দেখছে। এর অন্যতম কয়েকটি কারণ হচ্ছে, সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান, প্রায় ১৬ কোটি ভোক্তার অভ্যন্তরীণ বাজার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং কম মূল্যে সহজলভ্য শ্রমবাজার। দুই দশক আগে চীনে শ্রম মূল্য কম থাকায় পশ্চিমা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত সেখানে স্থানান্তর করে। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় এখন তারা চীনের ওপর বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা কাটাতে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল গ্রহণ করেছে। আর চীনের সঙ্গে এই ‘ওয়ান’ কান্ট্রি হওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেই অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে অনেক দেশ। চীন থেকে বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা কাটাতে এশিয়ার অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ স্থানান্তর করতে চায় বিনিয়োগকারীরা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তারা পছন্দের তালিকায় রেখেছে। অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অনেক কোম্পানিই এখানে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। তবে এজন্য সরকারের নীতি সহায়তার পাশাপাশি জমি ও অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। দেশীয় অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অটোমোবাইল শিল্পেও অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এটি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজভিত্তিক শিল্প। ছোট ছোট অনেক শিল্পই এর সঙ্গে জড়িত। সে কারণে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পার্শ্ববর্তী চীন ও ভারতের অনেক বিনিয়োগকারী এখন বাংলাদেশের অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা চীনের সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগোলিক দিক দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগসূত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। এর একদিকে বিশাল ভারত অন্যদিকে মিয়ানমার। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের এই সম্ভাবনার বিষয়ে জাইকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সস্তা শ্রমের পাশাপাশি দেশটিতে শ্রমিকও সহজলভ্য। ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বেশি। ইংরেজি ভাষাতে সহজে যোগাযোগ করা যায়। এ ছাড়া স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি, গার্মেন্ট এবং চামড়া শিল্পে অগ্রগতি, মধ্যম আয়ের ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি, আকর্ষণীয় বাজার, পানির সহজলভ্যতা, কম রেটে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য অন্যতম পছন্দের তালিকায় রেখেছে। তবে দুই বছর আগের ওই প্রতিবেদনে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতাও তুলে ধরা হয়। যেগুলো ছিল— রাজনৈতিক ও শ্রম খাতে অস্থিরতা, অনুন্নত অবকাঠামো, বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন এবং নীতিতে অস্পষ্টতা, অদক্ষ জনশক্তি, ভূমির স্বল্পতা, বিদ্যুৎ স্বল্পতা এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার বিষয়গুলো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, চীন, জাপান, ভারত ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধিরা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। সর্বশেষ বৈঠকটি গত ৮ ডিসেম্বর ইইউ-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে পাঁচটি প্রতিবন্ধকতা দূর করার তাগিদ দিয়েছে ইইউ। এগুলো হচ্ছে— ব্যবসায়িক পরিবেশ ঠিক করা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন এজেন্সির মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ২০২১ সালে দেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ৬০ বিলিয়ন (৬ হাজার কোটি) মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য অর্জনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। এগুলোর উন্নয়ন কাজ চলছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে ভারত, চীন, জাপান ও ইইউএর বিনিয়োগকারীদের চাহিদা মোতাবেক সব ধরনের সহযোগিতা দেবে সরকার।