নব আনন্দে জাগো নব রবি কিরণে

আমাদের নিজেদের নববর্ষ থাকার পরও ইংরেজি নববর্ষের দাপটই বেশি। জীবনে জীবনপ্রবাহে এর প্রভাব অসামান্য। কজন বাঙালি বলতে পারবে বাংলা তারিখ? কজনে জানেন বাংলা মাস কোনটি কত দিনে হয়? বাংলা তারিখ বাংলা পঞ্জিকা আমাদের জীবনে অল্প কয়েকটি দিন বা উৎসবের বাইরে তেমন কোনো গুরুত্ব বহন কওে না। ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস টানা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। যেভাবেই হোক এই নববর্ষ উদযাপনে আজ অনেক বেশি জৌলুস। এর সঙ্গে তারুণ্যের যোগাযোগ গভীর। তাই যদি না হবে থার্টিফার্স্ট নাইট নিয়ে আমাদের নিরাপত্তাবিদরা কি আসলে এত চিন্তিত হতেন? এই রাতটি ইংরেজ শাসিত উপনিবেশ বা তাদের দেশ ছাপিয়ে এখন পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। আমি যখন এ লেখা লিখছি, কমিউনিস্ট শাসিত ভিয়েতনামের উত্তর প্রান্ত অর্থাৎ হ্যানয়তেও চলছে জোর প্রস্তুতি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে চলছে রাস্তাজুড়ে প্যান্ডেল খাটানোর কাজ। আলোকসজ্জায় জেগে ওঠা উৎসবের এই প্রাক-পর্বে দুনিয়ার নানা দেশের মতো বংলাদেশেও জেগে ওঠে। জেগে ওঠে তারুণ্যের প্রাণস্পন্দনে। সে স্পন্দন ভালো না মন্দ তার চেয়ে বড় এখন এর ওপর আক্রমণ বা ঝাঁপিয়ে পড়ার উদগ্র বাসনা। জঙ্গিবাদ নামের নতুন মৌলবাদী ভূত কিছুই ছাড় দিতে রাজি না। তাদের চোখে সব কিছু হারাম। ধর্মের নামে অনাচার আর অন্ধত্বের নিশান ওড়ানো এরা ঢাকাসহ সারা দেশে তারুণ্যের উৎসবকে ভয় পায়। থার্টিফার্স্ট নাইটকে এরা অস্ত্র, বোমা বা ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করতে চায়। কিন্তু কেন? বছরের শুরুর দিনটিকে তাদের ভয়ের কারণ কি?
আসলে কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আনন্দ-উল্লাস। এই রাতে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের কথা বলছি না। বাকিরা মূলত দিনটিকে ঘিরে রাতটিকে সঙ্গে নিয়ে নতুন দিনের প্রত্যাশায় আনন্দে মেতে ওঠে। দুনিয়ার এত দেশে এতভাবে তার উদযাপন অথচ খুব কম দেশে আমাদের মতো ভয়ের কারণ দেখতে পাই। জঙ্গিবাদের নতুন দোসর যেসব তরুণ-তরুণী তারা এখন এ দিনকে হারাম মনে করেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই উৎসব আজ অনেক পরিচিত অনুষঙ্গের মতো বিপদের মুখে। বাংলাদেশে নতুন বছরের শুরুতে এই ভয়ের পেছনে আছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। একদা আমরা বাঙালি হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। সে সংগ্রাম যখন সার্থক, যখন আমরা আন্তর্জাতিক মানুষ হওয়ার কথা, তখন চলছে পেছনে টেনে ধরার অপচেষ্টা। আজকাল জঙ্গি ধরা বা জঙ্গি আস্তানার খবর পাওয়া সাধারণ ঘটনা। বিগত বছরগুলোতে আমাদের মনোজগতে ঘটে গেছে বিশাল পরিবর্তন। কোনটা যে পাপ আর কোনটা পুণ্য সে বিচারেই দিন গুজরান আমাদের।
নববর্ষে সব জাতি সব মানুষের চাওয়া এক ধরনের না। আমেরিকা বিলেত ইউরোপ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের চাওয়া আর আফ্রিকার চাওয়া এক হতে পারে না। দুনিয়ার একেক দেশে একেক রকমের সমস্যা। কোথাও মানুষের চাওয়া নতুন বছরে ভালো থাকা। ভালো খাওয়া। কারো চাওয়া পানীয়জল। কারো চাই বৃষ্টি। আবার ধরুন সিরিয়া ইরাকের মতো দেশে মানুষ চায় যুদ্ধের অবসান। তারা ভাবে কবে ফিরে আসবে স্বাভাবিক জীবন। কবে তাদের সন্তানেরা পারবে নির্ভয়ে স্কুলে যেতে। আফগানিস্তানের মতো দেশে নববর্ষে চাওয়া কি হতে পারে? তারা হয়তো চাইতেই ভুলে গেছে। শেষ কবে সে দেশের মানুষ আনন্দ আর উৎসবে মেতে নির্ভয়ে নববর্ষ পালন করেছিল? সে বোধহয় ইতিহাসেরও মনে নেই। আমরা এসব দেশের তুলনায় অনেক ভালো আছি। আমাদের দেশে এখন উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো প্রায় পূরণের পথে। আগের মতো ভিখারি নেই। রাস্তাঘাটে হাটেবাজারে অভাবী মানুষের আহাজারি নেই। সরকারের ভেতর ও অনুদান বা সাহায্যের জন্য কাঙালিপনা নেই। বরং আমাদের প্রধানমন্ত্রী জোরগলায় বলেন, আপনারা তালিকা করুন। সরকার গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিত করবে। আমাদের জীবদ্দশায় এমন ঘোষণা বা প্রত্যয় শুনতে পাব কখনো ভাবিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা মানুষের কষ্ট দেখেছি। লঙ্গরখানা খুলে রুটি সংগ্রহ করেছি। নিজেরা একবেলা রুটি খাওয়া তরুণ আমরা। আমাদের সময় দু’একটি ভালো জামা আর গুটিকয়েক প্যান্ট এই ছিল পোশাক। আমাদের যৌবনে চাকরি পাওয়া ছিল সোনার হরিণ পাওয়া। আমাদের সময় একনায়কের শাসনে মিডিয়া ছিল না। সত্য বলা যেত না। খালি তোষামোদ আর স্তাবকতা। আমরা আমাদের গৌরব পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু-রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বটে তবে না থাকার মতো। এ দেশের অভিভাবকহীনতার চরম দুঃসময়ে আমাদের যৌবন পড়েছিল বিপদের মুখে। প্রায় পাকিস্তানের ছায়ারাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এটা আমি অন্তত ভাবতে পারিনি।
তাই আমি শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। তার বলিষ্ঠতা আর নেতৃত্ব ছাড়া এ দেশ রাজাকারদের বিচার ও শাস্তি দিতে পারত না। আজকে উন্নয়নে আওয়ামী লীগারদের যত লুটপাট আর বদনাম থাকুক না কেন বিশাল অংশ কিন্তু জনগণের কাছেই যাচ্ছে। সেটিও হতো না। তিনি আমাদের যুবরাজ আর জামায়াতের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এ দেশের আসল চরিত্র আর সঠিক দিকনির্দেশনাও এসেছে তার কাছ থেকে। ইংরেজি নববর্ষে আমরা এ দেশকে সেভাবেই দেখতে চাই। বদলে যাওয়া কতিপয় সুবিধাবাদী আর অন্ধ রাজনীতি ও মৌলবাদের চররা যেন এ দেশের মগজ চিবিয়ে খেতে না পারে। এদের হাতে গেলে এ দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে। আর একবার তা হলে ইহজীবনে তাকে আসল জায়গায় আনা যাবে না।
বাংলাদেশের মেধা ও মনন এখন বিশ্বস্বীকৃত। আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী দেশে-বিদেশে পরিশ্রম করে সুনাম অর্জন করছে। দেশের বালক-বালিকা কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা আমাদের মতো পুরনো বই দিয়ে আর জীবন শুরু করে না। সব দিকে এক নতুন গন্ধ আর ভালোবাসার ছোঁয়া আছে। মানুষের খাবার, পোশাক, জীবনবোধ ঘরবাড়িতেই আছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখন বাংলাদেশকে কেউ চোখ রাঙাতে পারে না। ভয় দেখাতে পারে না। তারপরও আমরা এ দেশ এ জাতি আর এই দেশের ইতিহাসকে অপমান করি। মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ আমাদের ভালো লাগে না।
নববর্ষে এই বৈপরীত্যের অবসান কামনা করি। বাংলাদেশ হয়ে উঠুক আনন্দ আর ভালোবাসার এক মুক্ত ভূমি। এটাই ছিল স্বাধীনতার স্পৃহা। এটাই আমাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা।