২০১৫ বাংলাদেশের ক্রিকেটে শুধু সাফল্য আর সাফল্য। দলীয় ও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ক্রিকেটবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মাশরাফি মুর্তজারা। দলীয় পারফরম্যান্সে যদি বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠাকে এগিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয় কোথায় রাখা যায়? শুরুতে বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহর ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরিই মনে হয়েছিল বছরের সেরা পারফরম্যান্স। কিন্তু মাঝামাঝিতে মুস্তাফিজুর রহমানের অভিষেক সব হিসাব পাল্টে দিল। ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হয়ে রইলেন এই বিস্ময় কর পেসার। টেস্টে তামিম ইকবালের ডাবল সেঞ্চুরি, অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজার দুর্দান্ত নেতৃত্ব- সবই বাংলাদেশ ক্রিকেট সাফল্যের একেকটি পাঁপড়ি।
২০১৪ সালে জয়ের খুব কাছে গিয়ে একাধিক ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ। শেষদিকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে হারের বৃত্ত থেকে বেরিয় আসে টাইগাররা। ২০১৫ সালের শুরুতে মাশরাফি বলেছিলেন, এ বছর আমাদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। চ্যালেঞ্জ নিতে পারলে আমাদের অনেক অর্জন হবে।’ বিশ্বকাপের শুরুতে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের ফল ভালো হয়নি। আয়ারল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে হার। আসল লড়াইয়ে বদলে যায় চিত্র। বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বড় জয় দিয়ে শুরু। এরপর স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৯ রান তাড়া করে জয় পেয়ে নতুন উচ্চতায় ওঠে বাংলাদেশ। এর আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কারও সেঞ্চুরি ছিল না। সেখানে মাহমুদউল্লাহ দুটি শতক হাঁকিয়ে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রুবেল হোসেনের বোলিংও উল্লেখ করতে হয়। প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেও ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের হার প্রশ্নের ঝড় তোলে। বিশ্বকাপে অভূতপূর্ব সাফল্যে মাশরাফিদের বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয় দেশে ফেরার পর। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে হেসে-খেলে সিরিজ জয় করলেন মাশরাফি। ওয়ানডে ও টি ২০ মিলে বাংলাদেশ ৪-০তে হারাল পাকিস্তানকে। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে খুলনায় দাপট দেখিয়ে বাংলাদেশ ড্র করে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করেন তামিম ইকবাল। ওই ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১২ রানের ওপেনিং জুটি গড়ে রেকর্ডের পাতায় নিজেদের নাম লেখান তামিম ও ইমরুল। যে কোনো উইকেটে সেটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে বিশ্বরেকর্ড।
পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি টেস্ট ড্র করার পর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আরও তিনটি টেস্ট ড্র করে বাংলাদেশ। যদিও তাতে বৃষ্টির অবদান ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট বৃষ্টির পেটে যাওয়ার আগে জয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন মুশফিকরা। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট ছিল দুটি। নিরাপত্তার অজুহাতে অসিরা না আসায় সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে টাইগারদের।
২০১৪ সালে টানা ১২ ওয়ানডে ম্যাচে হেরেছিল যে দল, তারাই ২০১৫তে ১৮ ওয়ানডের মধ্যে জিতেছে ১৩টিতে। কোনো সিরিজ হারেনি। বাংলাদেশ ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার স্বপ্ন পূরণ করে র্যাংকিংয়ে সাতে উঠে। জয়ের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশ ছিল এশিয়ায় শীর্ষে। বাংলাদেশ যে ফরম্যাটে সবচেয়ে দুর্বল সেই টি ২০তেও পাঁচ ম্যাচের দুটিতে জিতেছে। বাংলাদেশের এই সাফল্যর পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি মাশরাফি। পুরো দলকে উজ্জীবিত করে একটি পরিবার হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান ও মোহাম্মদ শহীদদের অভিষেক হয় ২০১৪ সালে। ২০১৫তে নিজেদের চিনিয়েছেন তারা। মুস্তাফিজুর রহমানের আগমনে বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দেখতে শুরু
করেছে বিশ্ব ক্রিকেট। অভিষেকে পাঁচ উইকেট নেয়ার পর এক বছরে সর্বোচ্চ তিনবার পাঁচ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি। ধোনি, ডি ভিলিয়ার্স, কোহলি, আফ্রিদি, গেইল- সবাই আত্মসমর্পণ করেছেন তার কাছে।
পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করাটা ছিল জরুরি। সেটাই হল। বছরের শেষে রোমাঞ্চ নিয়ে আসে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল)। ভালোভাবেই শেষ হয়েছে বিপিএল। জাতীয় দলের মতো এখানেও জাদুকরি অধিনায়কত্ব দেখিয়েছেন মাশরাফি। একটা সাধারণ দল নিয়েও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন তিনি। বিপিএলে সবচেয়ে বড় পাওয়া বাঁ-হাতি পেসার আবু হায়দার রনি। তার বোলিং দেখে আরেকজন মুস্তাফিজ পাওয়া গেছে, এমন কল্পনাও করেছেন কেউ কেউ। জাতীয় দলের ব্যস্ততার মাঝে ঘরোয়া ক্রিকেট গত বছর নিয়মিত মাঠে গড়িয়েছে। বছরের শুরুতে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জেতে প্রাইম ব্যাংক, এরপর বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগের (বিসিএল) শিরোপা জেতে প্রাইম ব্যাংক দক্ষিণাঞ্চল। জাতীয় লীগের দুই মৌসুমের শিরোপা জিতেছে রংপুর ও খুলনা।
এত সাফল্যর মধ্যেও কিছু বিতর্ক থেকে গেছে। শৃংখলাভঙ্গের দায়ে বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফিরতে হয় পেসার আল-আমিন হোসেনকে। আরেক পেসার শাহাদাত হোসেন গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের অভিযোগে জেল খেটেছেন। বিশাল সাফল্যে এই দুটি ঘটনা না হয় আড়ালেই থাক। বাংলাদেশ দলের কাছে এখন সমর্থকদের চাওয়া অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে যৌবন সেটা ধরে রাখার নতুন চ্যালেঞ্জ ২০১৬তে। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও এশিয়া কাপ শেষে ভারতে টি ২০ বিশ্বকাপ। বড় দল হয়ে ওঠা বাংলাদেশ নতুন স্বপ্নযাত্রা শুরুর অপেক্ষায়।