তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানির লক্ষ্য : পাঁচ নয় পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার

এটি এখন বাংলাদেশ সরকার ও দেশের বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রধান লক্ষ্য ও অঙ্গীকার যে, ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন ও ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার সময়কালে যা এই দেশটির স্বাধীনতারও ৫০ বছর পূর্ণ হবে তখন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। বহুদিন আগে থেকেই এমন বড় একটা স্বপ্ন আমরা দেখে আসছি। সেই ১৯৯৭ সালে যখন রপ্তানি করার উপায় উদ্ভাবনে সেমিনার করি এই স্বপ্ন তখন প্রকাশ্যে ঘোষণা করি আমরা। এরপর দিনে দিনে এই স্বপ্ন বড় হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর ২০১৬ সমাপ্ত হওয়া ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডেও এই অঙ্গীকার নানা স্তর থেকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরা সফটওয়্যার ও সেবাখাতের পক্ষ থেকেও এই অঙ্গীকারের অংশ হয়েই আছি। দেশের মিডিয়া থেকে নীতিনির্ধারকদের মাঝে প্রসঙ্গটি কেবল কৌত‚হলোদ্দীপক নয়, বরং চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। বিশেষত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আমাদের ২০১৫-১৬ সালের রপ্তানি আয় মাত্র ১৫১.৯ মিলিয়ন ডলার বলে গণ্য করে তখন আমাদের জন্য ১ বিলিয়নই হোক বা ৫ বিলিয়নই হোক সেটি অর্জন করা যে প্রায় অসম্ভব তেমনটিই ধারণা করা হয়ে থাকে। চারপাশ থেকেই এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, আমরা যেন কোনোভাবেই ১ বিলিয়ন বা ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারব না। কিন্তু ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলককে যে তারা উভয়েই আমাদের শিল্প খাতের মতোই বিশ্বাস করেন যে, এমন একটি স্বপ্ন আমাদের বেসরকারি খাত অর্জন করতে সক্ষম। আমি এই খাতের বৃহত্তম বাণিজ্য সংগঠন বেসিসের সভাপতি হিসেবে বলতে পারি যে, আমাদের হিসাবটা ৫ বিলিয়নের নয়, বরং ৫০ বিলিয়নের। হিসেবটি আমার এই নিবন্ধ থেকে বুঝে নিতে পারেন।
কেন বা কেমন করে আমরা এই সফলতা অর্জন করতে পারব সেগুলো আমরা একটু তলিয়ে দেখতে পারি। অন্যদিকে এটিও আমাদের দেখা দরকার যে এই অর্জনের জন্য সরকারের ও এই খাতের কোনো কোনো করণীয় রয়েছে। প্রথমেই নজর দেয়া যাক দুনিয়ার আউটসোর্সিং বাজারটি কত বড় তার দিকে। আমরা জেনেছি যে, ২০১৫ সালে বিশ্বজুড়ে আউটসোর্সিং বাজারের মূল্য ছিল ৮৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৭ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার। তবে লক্ষণীয় যে, বিগত সময়ে এই বাজারের প্রবৃদ্ধি তেমন নয়। ২০১০ সাল থেকে যে চিত্রটি আমাদের সামনে আসে তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। বিশ্ববাজারে আউটসোর্সিং আয় হিসাবটি আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার অথরিটি এক্সিলারেন্স থেকে পাওয়া।
ওয়েবসাইট লিংক : http://www.accelerance.com/ research/global-it-market-size-facts-and-figures
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং বাজারের বিকাশের জন্য ভিত্তিগত পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। দেশের আউটসোর্সিং শিল্প ক্রমেই আরো পরিপক্ব হয়ে উঠছে, একই সঙ্গে অনেকে দেশের বাইরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন। ভৌগোলিকগত দিক থেকে ৯০ শতাংশের বেশি আইটি খাতে ব্যয় হয় উত্তর আমেরিকা (৩৯.৩৩), পশ্চিম ইউরোপ (৩১.৭৪) এবং এশিয়া প্যাসিফিক (১৯.১৪) অঞ্চলে। বর্তমানে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং সেবার একটি বড় অংশ যায় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ায়। এ দেশের উদীয়মান রপ্তানিকারকরা তাদের যোগ্যতার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছে। বাংলাদেশ সুলভ মানবসম্পদসহ আরো অনেক দিক দিয়েই ভারত এবং ফিলিপাইন থেকে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশকে আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা হয়। গার্টনার বাংলাদেশকে আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ ৩০টি দেশের মধ্যে স্থান দিয়েছে। এটি কারনির সার্ভিস ইন্ডেক্সেও বাংলাদেশের অবস্থান আরো ৪ ধাপ এগিয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি নিন্মরূপ :
আমরা যদি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যাদিকে বিশ্লেষণ করি তবে আমাদের দেশের রপ্তানির চিত্রটিও বিচিত্র। আমাদের প্রবৃদ্ধির হিসাবটিও সরল রেখায় ওঠা-নামা করছে না। কখনো সেটি ৫৬.২৮ ভাগ বেড়েছে। আবার কখনো সেটি মাত্র ৪.৭১ ভাগ বেড়েছে।
বিশ্বে আউটসোর্সিং বাজারের আকার নিয়ে গবেষণায় জানা গেছে যে, গত ৩ বছরে দেশগুলোর আইটিতে ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি অস্থিতিশীল। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর। এ থেকে বোঝা যায় আমাদের দেশীয় আউটসোর্সিং সেবার চাহিদা বহির্বিশ্বে বেশ ভালোভাবেই আছে। প্রসঙ্গত, এটি উল্লেখ করা দরকার যে ভারত ২০১৫ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এখন ৯৯ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। ২০১৬ সালে ১১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির আশা করে। তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে ২০১৫ সালে ১৪৬ বিলিয়র ডলারে উন্নীত করেছে যার বৃহত্তম অংশ ই-কমার্সের। আমরা ভিয়েতনামের হিসাবটা পেয়েছি ২০১৫ সালে তারা ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। ইপিবির হিসাবের (১৫১.৯ মিলিয়ন ডলার) পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সূত্র মতে, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)তে গত বছরে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সার আয়ের সঠিক হিসাব না থাকলেও তাদের আয় কমবেশি ১০০ মিলিয়ন ডলার বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল গেইমিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে আমাদের আইটি সেক্টর, ফ্রিল্যান্সিং- সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে বলে সরকারিভাবে বলা হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে প্রযুক্তি সেবায় বিপুল পরিমাণ আয় হলেও তা ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আসছে না। আমরা রপ্তানি আয়ের বিচিত্র একটি ধারণা পাই যদি বেসিস সদস্যদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করি। বর্তমানে বেসিস সদস্যভুক্ত আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬। এদের মধ্য থেকে ৩৮২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা গত বছর ৫৯৪.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানি করেছে। বেসিস সদস্যভুক্ত নয় দেশে এমন আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্তত আরো ১০০০। এই হিসাব থেকে সমগ্র খাত সম্পর্কে একটি আন্দাজ করা যায়। ২০১৫ সালে দেশের আইটি রপ্তানির আনুমানিক চিত্র : ৩৮২টি বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয়৫৯৪.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৯৫৬টি সদস্য প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় (আনুমানিক)১৪৮৮.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারবেসিস সদস্যভুক্ত নয় এমন ১০০০টি আইটি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় (আনুমানিক) ১৫৫৬.৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মোট রপ্তানি (আনুমানিক) ৩০৪৫.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে এটি সত্য যে, আইটি খাতের সব প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করে না। সে ক্ষেত্রে যদি ধরা হয় তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ রপ্তানি কাজে জড়িত, তবুও এর পরিমাণ প্রায় ৭৬১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এটি উল্লেখ করতে চাই যে, গত ১৯-২১ অক্টাবর ২০১৬ ঢাকার বসুন্ধরা কনভেনশন সিটিতে আয়োজিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডয়ের মাঝে ১৯ অক্টোবর বিকেল ৩টায় সম্পন্ন মিনিস্টারিয়াল কনফারেন্সের মূল প্রবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের রপ্তানি এখন ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এতে বোঝা যায় যে, বেসিসের হিসাবটির সত্যতা সরকারিভাবেও রয়েছে।
আমাদের রপ্তানি কত সেই অঙ্কটি নিয়ে আমরা যত কথাই বলি না কেন আমাদের জন্য দায়িত্বশীল কাজ হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক উপাত্ত সংগ্রহ করে অঙ্কটি নির্ণয় বা নিশ্চিত করা। বেসিস বা সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের জরিপ করা অগ্রাধিকার পেতে পারে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের কাছ থেকে জেনেছি যে, ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে সফটওয়্যার ও সেবাখাতের আয়কে রিপোর্ট করে না বলে তাদের হিসাবকেও তারা সঠিক বলতে পারেন না। আমি নিজে বাংলাদেশের একটি বড় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের খবর জানি যারা ১২.৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশে আয় করে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান ৫৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে কিন্তু সেটি আমাদের ব্যাংকের রপ্তানি হিসেবে আসেনি। কিন্তু তাদের একটি ডলারও তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি হিসেবে রিপোর্ট করা হয় না। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের হিসাব এভাবে করে তার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না এই বিষয়ে আমদের কোনো সন্দেহ নেই। তবে হিসাবের চাইতেও অনেক বড় প্রসঙ্গ হচ্ছে করণীয় নিয়ে। প্রথমত, বেসরকারি খাতের কথাই আগে বলা যায়। আমি মনে করি আমরা বিগত সময়ে পুরো বিষয়টিকে বাস্তবানুগভাবে না দেখে অনেকটা অন্যের দেখানো পথে হেঁটেছি এবং যুক্তির চাইতে আবেগের দিকে বেশি নজর দিয়েছি। আমি এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের ঔদাসিন্যের কথাও বলতে পারি। অতীতে আমরা বছরের পর বছর রপ্তানি বলে চিৎকার করলেও একবারও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের কথা বলিনি। এর ফলে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়লেও দেশের ভেতরের বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ করেছে। আমরা রপ্তানির প্রণোদনার কথাও তুলে ধরতে পারিনি।