জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান

একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর একটি জাতি তৈরি করাই শিক্ষার লক্ষ্য। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। সরকারের এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। সরকারের জনমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্কুল, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠাপূর্বক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে, যা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার নাগরিকের সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যসূচির পাশাপাশি খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম, শৃঙ্খলা, নৈতিক শিক্ষা, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত প্রেষণা প্রদান করা হয়ে থাকে। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীগণকে ICT বিষয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানে এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করছে। একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান ও অর্জন অনন্য সাধারণ।

ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও কলেজ

দেশের সর্বত্র শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষার আলোয় সমাজকে আলোকিত করার প্রয়াসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পশ্চাত্পদ ও দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ দেশের প্রত্যেকটি সেনানিবাসে স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদেরকে শৃঙ্খলা, নৈতিক মূল্যবোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, শিষ্টাচার সহজীবন-যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, সহিষ্ণুতা, অধ্যাবসায় ইত্যাদি গুণাবলী অর্জন করে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক, কুসংস্কারমুক্ত একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বশীল তদারকি এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকগণের আন্তরিক পরিচর্যার কারণে এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় পরীক্ষাসমূহে ঈর্ষণীয় ফলাফল অর্জন করছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাঠ্যসূচির পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এ জাতীয় মোট ৪৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৯৯,১২৩ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সেনানিবাসে মোট ৩৯টি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুল ও কলেজ রয়েছে। সেনাবাহিনী এবং সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদপ্তর-(ডিএমএলসি) এর সমন্বয়ে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানসমূহে বর্তমানে মোট ৫২,০৩৮ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে।

ক্যাডেট কলেজ

উন্নত ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদান ও সশস্ত্র বাহিনীর জন্য চৌকস অফিসার তৈরির লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে বাংলাদেশে তিনটি মহিলা ক্যাডেট কলেজসহ মোট ১২টি ক্যাডেট কলেজ রয়েছে। সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিশেষায়িত এ সকল প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাডেটদের ভবিষ্যত্ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারদর্শী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়াও ক্যাডেট কলেজের আদলে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অফিসার তৈরির লক্ষ্যে ২০০২ সালে মিলিটারি কলেজিয়েট স্কুল খুলনা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সামরিক অফিসারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ, নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাডেটদেরকে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য চৌকস অফিসার তৈরির পাশাপাশি দেশের অন্যান্য পেশায় সত্, দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (BUP)

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল দেশের ৩৯তম পাবলিক ইউনিভার্সিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, যুদ্ধ কৌশল, মেডিক্যাল, প্রকৌশল ও তথ্য প্রযুক্তি এবং বিজনেস স্টাডিজসহ অন্য বিষয়েও বিইউপি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিইউপি নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স, এমবিএ, এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। এছাড়াও বিইউপি অধিভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (MIST)

বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি এর কার্যক্রম শুভ উদ্বোধন করেন। এই প্রতিষ্ঠান হতে অদ্যাবধি ২৫৩৭ জন শিক্ষার্থী সফলতার সঙ্গে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাশাপাশি এমএসসি, এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ২০১৫ সালে সৈয়দপুর, কাদিরাবাদ ও কুমিল্লা সেনানিবাসে যথাক্রমে বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি (BAUST), বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (BAUET) এবং বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি (BAIUST) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ (AFMC)

আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির প্রতিপাদ্য বিষয়, “সুস্বাস্থ্য উন্নয়নের হাতিয়ার।” একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে সুস্থ ও সবল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানসম্পন্ন চিকিত্সক তৈরির লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তত্কালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজে অদ্যাবধি ৮৬৬ জন ক্যাডেট এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করেছে। শিক্ষা সমাপনকারী গ্রাজুয়েটগণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং অসামরিক পরিমণ্ডলে চিকিত্সাসেবা প্রদান করে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। এ ছাড়াও মানসম্পন্ন চিকিত্সক তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, বগুড়া এবং রংপুর সেনানিবাসে পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (AIBA)

বর্তমান বিশ্বে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাভার এবং সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ৫ মার্চ ২০১৫ এই প্রতিষ্ঠান দুটির উদ্বোধন করেন। সুশৃঙ্খল পরিবেশ এবং আন্তরিক পরিচালনায় এই প্রতিষ্ঠান দুটি আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে অবদান রাখবে।

প্রয়াস

আমাদের সমাজ বাস্তবতায় প্রতিবন্ধী মানুষকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাধা হিসেবে মনে করা হলেও বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে প্রতিবন্ধীদের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশু/কিশোরদের যথাযথ শিক্ষা, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, কর্মমুখী শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে স্বনির্ভর এবং সমাজের স্বাভাবিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত করার মহত্ উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান “প্রয়াস” প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছে। বিশেষ শিশুদের সুবিধার্থে বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থিত প্রয়াসের বিশেষ বিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদেরকে প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা দ্বারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। শিশুর শারীরিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ ও থেরাপিউটিক সেবা, মনোবৈজ্ঞানিক টেস্ট, অডিওলোজি টেস্ট, ইইজি পরীক্ষাসহ শিশুর বাক, শ্রবণ ও যোগাযোগ ক্ষমতা পরিমাপ করে শিশু ও শিশুর অভিভাবককে প্রশিক্ষণ, কাউন্সিলিং বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত এবং সেনানিবাসস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। অন্যদিকে সরকারি মেডিক্যাল কলেজসমূহে প্রেষণে অফিসার নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রাখছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তাগণের দক্ষ পরিচালনার ফলে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (BKSP) দেশীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুনাম অর্জন করছে। যুগোপযোগী এবং আধুনিক টেকসই শিক্ষা প্রসারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অবদান নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তস্বরূপ।