পরিবেশবান্ধব ট্যানারি যুগে বাংলাদেশ

সবুজ ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোশাক কারখানা তৈরি করে এরই মধ্যে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। সবুজ কারখানায় তৈরি বাংলাদেশি পোশাক নিয়েও বেশ আগ্রহী বিদেশি ক্রেতা।

আর সবুজ পোশাক কারখানার পর এবার একইভাবে দেশের ট্যানারি শিল্প নতুন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। খুব শিগগিরই ঢাকায় ট্যানারি শিল্পের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘গ্রিন ট্যানারি’ বা ‘সবুজ ট্যানারি’র যাত্রা শুরু হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ হবে অন্যদিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি চামড়াজাত পণ্য নিয়েও আগ্রহ তৈরি হবে। বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত না হওয়ায় বিশ্বের খ্যাতনামা ব্র্যান্ডগুলো এখানকার চামড়াজাত পণ্যে আগ্রহী নয়। বর্তমানে বিশ্ব চামড়া বাজার থেকে বাংলাদেশের বার্ষিক আয় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার। আর পোশাক খাতের সবুজ কারখানার মতো যদি চামড়া শিল্পে ‘গ্রিন ট্যানারি’র ধারণা জনপ্রিয় হয় তবে এ খাতেও বিদেশি ক্রেতাদের বেশি করে টানা সম্ভব। এরই মধ্যে সরকার চলতি মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে যে কোনো মূল্যে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের জন্য চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। নির্ধারিত এ সময়ের মধ্যে যেসব ট্যানারি মালিক সাভারে কারখানা স্থানান্তর করতে পারবে না ২০১৭ সালে পয়লা জানুয়ারি থেকে সেসব কারখানার গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ট্যানারি শিল্প মালিক সমিতির নেতারা জানান, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারি স্থানান্তর কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। এ সময়ের মধ্যে ট্যানারি স্থানান্তর করে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা হবে। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বাস্তবায়নাধীন ‘চামড়া শিল্পনগরী-ঢাকা’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে আয়োজিত এক সভায় ট্যানারি মালিকরা এসব কথা জানান। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্পনগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকার অদূরে ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অধিগ্রহণকৃত সমগ্র এলাকাকে ২৫৫টি প্লটে বিভক্ত করে ১৫৫টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্লট বরাদ্দ পাওয়া ট্যানারি কোম্পানির সিংহভাগই তাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শেষ করেছে। বর্তমানে শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) দুটি মডিউল চালু আছে। এরই মধ্যে ২৪টি ট্যানারি কারখানা চামড়া উৎপাদন কাজ শুরু করেছে। ৫০টি ট্যানারি কারখানা ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করেছে। খুব শিগগিরই অন্যান্য ট্যানারিও উৎপাদনে যাবে। শিল্প নগরীর ১৫৫টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলোর লে-আউট অনুমোদিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজও প্রায় শেষ। এরই মধ্যে ১২৯টি ট্যানারি মালিক কারখানায় স্থায়ী বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বরাবর আবেদন করেছে। আর কারখানা চালুর জন্য ২৫টি ট্যানারি স্থায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলতে পরিবেশের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ট্যানারি কারখানাগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। এতে শিল্প বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবহারসহ শিল্প এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। এখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে বর্জ্য হতে ক্ষতিকর উপাদান বের করে পরে তা পরিবেশে ছাড়া হবে। নতুন ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে। এদের নির্মাণাধীন সিইটিপি’টি মোট ছয়টি মডিউলের সমন্বয়ে গঠিত। যার চারটি মডিউলের সাহায্যে প্রতিদিন ১৫৫টি ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব। এ ছাড়া শিল্প এলাকায় খাওয়ার ও শিল্পে ব্যবহারের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। জানা যায়, কিছুদিন আগে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বন্ধ কারখানা ‘ঢাকা লেদার’-কে পরিবেশবান্ধব করে তা গ্রিন ট্যানারি হিসেবে আবার চালুর প্রস্তাব দিয়েছে ইতালির চামড়া শিল্প উদ্যোক্তাদের একটি দল। কারখানাটি তারা এমনভাবে গড়ে তুলতে চায় যেখানে হাতের স্পর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা যাবে। এই প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই শেষে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু জানান, পরিবেশবান্ধব ট্যানারি স্থাপন হলে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়বে না, আবার চামড়াজাত দ্রব্যের বিশ্বমানও বজায় থাকবে। ট্যানারিতে চলমান প্রযুক্তিতে শতভাগ চামড়া রপ্তানি করা সম্ভব না। তবে পরিবেশবান্ধব ট্যানারি স্থাপন করা গেলে তা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর ২০০৯ সালের ৩ জুন আরেক আদেশে ট্যানারি সরানোর জন্য ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। এরপর বেশ কয়েকবার সরকার পক্ষের আবেদনে সময়সীমা বাড়ানো হলেও ট্যানারি স্থানান্তরে উচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ গত ১৮ জুলাই হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর না করা পর্যন্ত ১৫৪টি ট্যানারির মালিককে পরিবেশ দূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দেওয়াসহ সরকারি চাপে পড়ে ট্যানারি মালিকরা ধীরে ধীরে সাভারে যেতে শুরু করেন।