সবজি চাষে নারীর নীরব বিপ্লব

খুলনা জেলার বটিয়াঘাটার অঞ্জনা সিংহ নিজ বাড়ির আঙিনা ও ক্ষেতে সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে তিনি সবজি চাষ শুরু করেন। মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, করলা, সিম, লাউ, লাল শাক, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন শাক_সবজির চাষ করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে সামিল তিনি। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের সুখদাড়া গ্রামে বাড়ি অঞ্জনার। নিজের শ্রম ও শক্তি দিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন সংসারের আর্থিক সচ্ছলতা।
স্বামীর মৃত্যুর পর চরম আর্থিক সমস্যায় পড়েন তিনি। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকা এবং ছোট দুটো সন্তানকে নিয়ে কী করবেন এ নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। যেহেতু উপার্জনের অন্য কোন পথ নাই তাই বাড়ির পাশেই কিছু আবাদ জমিতে শুরু করেন শাক_সবজির চাষ। এখন পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করে ভালো অর্থ উপার্জন করছেন তিনি। সবজি চাষে ভালো লাভ হওয়ায় তার মতো অনেকেই এ পেশা হিসেবে বেছে নেন সবজি চাষ। বাড়ির আঙিনা ও নিজেদের ১৫ কাঠা জমিতে শুরু করেন সবজি চাষ। এর থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই তার সংসারের চাকা ঘুরছে। সবজি রোপণসহ তিনি যাবতীয় কাজ করেন। তবে এ কাজে তার শাশুড়ি ও সন্তানরাও অনেক সহযোগিতা করে। প্রায় ১২ বছর ধরে সবজি চাষ করে এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। অঞ্জনা বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খুব দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছি। উপার্জনের অন্য কোন পথ না থাকায় নিজ বাড়িতেই শুরু করি সবজি চাষ। পরবর্তীতে শাশুড়ির সহযোগিতায় ক্ষেতের জমিতে চাষাবাদ শুরু করি। আর এটা করেই ছেলে মেয়ের লেখাপাড়া এবং সংসার চালাচ্ছি।
মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের চাঁদবিল গ্রাম। এই গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা ছালেহা বেগম স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন সবজি চাষ করে। ছালেহা জানান, ১০ বছর সংসার জীবনের পর তার স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে বিদেশে চলে যান। উপায় না দেখে একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন। থাকার জন্য তাকে একখ- জমি দেন বাবা। ওই জমিতেই একটি কুঁড়ে ঘর তৈরি করে ছালেহা বেগম বাকি জায়গায় সবজিসহ ফলের বাগান করেন। এখন সবজি ও ফলবাগান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে তার সংসার খুব সুন্দরভাবে চলে যায়। ছালেহা আরও জানান, তার বাগানের সবজি বিষমুক্ত হওয়ায় এলাকায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে তাকে বাজারে যেতে হয় না। বাড়ি থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। খুচরা এবং পাইকারি দুইভাবেই বিক্রি হয় তার সবজি।
শুধু অঞ্জনা, ছালেহা নয়, সারা দেশেই এখন সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন নারীরা। তারা এখন পরিবারের চাহিদা মেটাতে শুধু ঘরের আশপাশে বা ঘরের চালেই সবজি চাষ করেন না। তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও সবজি চাষে এগিয়ে এসেছেন। ফলে সবজির উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি পরিবারে আয়ের পথেও সহযোগী হচ্ছেন তারা।
বর্তমানে চরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় যে সবজি উৎপাদন হয়, তার মূল ভূমিকায় অংশ নিচ্ছেন নারীরাই। দেশের বিভিন্ন নদ_নদীতে জেগে ওঠা চরে এখন সারা বছরই সবজির ফলন হয়। তাতে জমি তৈরি করা, বীজ বপণ, পরিচর্যা, সবজি উঠানো ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই নারীরা প্রধান ভূমিকায় থাকেন। পুরুষরা প্রয়োজনে সহযোগিতা করেন। পুরুষরা তাদের নিজস্ব পেশা বা কাজে যুক্ত থাকেন। এমনিভাবে পাহাড়ি অঞ্চলেও এখন যেভাবে ফল বাগান ও সবজি বাগান গড়ে উঠেছে, তাতে নারীদের প্রাধান্যই লক্ষ্য করা যায়। পাহাড়ি নারীরা এমনিতে খুব কর্মঠ। তাই তাদের সবজি উৎপাদন অনেক ভালো।
দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীরা তাদের বাড়ির আশপাশের পতিত জায়গাকে বেছে নিয়েছেন সবজি চাষের জন্য। এতে পতিত জায়গার যেমন সদ্ব্যবহার হচ্ছে, তেমনি সবজির উৎপাদনও বাড়ছে। অনেকেই জমি লিজ নিয়েও সবজির আবাদ করছেন। সবজি চাষে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা কৃষকদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। উন্নত মানের বীজও সরবরাহ করা হচ্ছে। কোন কোন এনজিও স্থানীয় ভিত্তিতে সবজি চাষে নারীদের সম্পৃক্ত করছে। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে সবজি চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন। আগে পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্যই কেবল সবজি উৎপাদন করা হতো। এখন বাণিজ্যিকভাবে তা করা হচ্ছে। এতে একদিকে দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে অন্যদিকে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে অর্থনীতিতে তারা ভূমিকা রাখছে।
বর্তমানে এক কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। জমির পাশের উঁচু স্থান, রাস্তার পাশে, ক্ষেতের আইল, বাড়ির উঠোন, ঘরের চালা, মাচা কিংবা ভাসমান পদ্ধতিতে পানির ওপর এমনকি এখন শহরের অট্টালিকায় ছাদে ছাদে সবজির চাষ হচ্ছে। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। সবজি উৎপাদনের বার্ষিক বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন এবং আধুনিক প্রযুক্তি মূল ভুমিকা পালন করছে। গবেষণার মাধ্যমে উন্নত বীজ উদ্ভাবন ও কৃষিতে আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে দিন দিন সবজি উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বারি) এ পর্যন্ত ৫০ প্রকার সবজির আবিষ্কার করেছে।
১৯৭৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের সবজি রফতানি শুরু হলেও ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ববাজারে ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা। বর্তমানে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, মিরসরাই, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী, মাগুরা, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, কঙ্বাজার, সিলেট ও গাজীপুরের সবজি রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়। এসব সবজির মধ্যে করলা, কাকরোল, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, ঢেঁড়স, লাউ, কচুরলতি, কচুরমুখী, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, কাঁঠাল, শসা, চিচিঙ্গা, লালশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, পটোল, ঝিঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাক_সবজি রপ্তানি করে ৬০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রপ্তানি হয়। রপ্তানি আয় বাড়াতে ইউরোপের ২৭টি দেশে শতভাগ স্যালমোনিলামুক্ত পান ও ব্যাকটেরিয়ামুক্ত শাকসবজি রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বছরে সবজি রপ্তানি থেকে আয় হবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রয়োজন, বিদেশের বাজার ধরার ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হওয়া।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। কারণ শাকসবজি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও সব ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করে। তবে সে সবজি হতে হবে অব্যশই বিষমুক্ত। যেহেতু সব বসতবাড়ির আঙ্গিনায় কম বেশি খোলা জায়গা থাকে। তাই সেসব স্থানে শাকসবজি চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়েরও ব্যবস্থা করা যায়। মানুষের মধ্যে সবজি খাওয়ার প্রবণতা দিনদিনই বাড়ছে। আগে সবজির প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। ফলে আগে ঘরের চালেই লাউ, কুমড়া ইত্যাদির উৎপাদন হতো। এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও লাউ_কুমড়ার মতো সবজিরও চাষ হয়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুব সমাজের মাঝে সবজি চাষ আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। দেশে কৃষকের পাশাপাশি লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তরুণ উদ্যোক্তা শাক_সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় নিজেদের জমির পাশাপাশি বর্গা জমি নিয়ে সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এসব সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে অনেকেই।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)