বাসস্থান, ফসলি জমি রক্ষ ও ভূমির অপব্যবহার রোধ : দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে ফসলি জমি ও পরিবেশ। বর্তমানের নিয়ন্ত্রণহীন অপরিকল্পিকভাবে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান এবং ফসলি জমি রক্ষা দুটিই করতে হবে। রাষ্ট্র ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে নূ্যনতম মূল্যে তার নিজের ও পরিবারের জন্য নূ্যনতম বাসস্থান দেবে। যার বাসস্থান একসঙ্গে বা কিস্তিতে কেনার সামর্থ্য নেই রাষ্ট্র তাকে নূ্যনতম ব্যবস্থার বাইরে নাগরিকরা নিজস্ব অর্থে বড় আকারের বা নির্ধারিত উন্নত স্থানে বাসস্থান কিনতে পারবেন।
দেশের সব জমি, বাসস্থান, ফসলি জমি, খাল-বিল-নদী, জলাশয়, শিল্পাঞ্চল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ-মন্দির, ঈদগা, বনাঞ্চল, প্রত্নতত্ত্ব এলাকা, অভয়ারণ্য, মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, পার্ক বা কেলার জায়গা ইত্যাদি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকবে। বর্তমানের ছনের-টিনের-সেমিপাকা-পাকা ঘরবাড়ির বদলে কমিউনিটিভিত্তিক বহুতল উঁচু দালান নির্মাণ করে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এসব বাসস্থানের জন্য পানি-পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ বিনোদন, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি নিশ্চিত করা হবে। পরিবারপ্রতি ফসলি জমির সর্বোচ্চ সিলিং হবে দশ একর বা এক হাজার শতাংশ। বাসস্থানের জন্য রাজধানী শহরে ব্যক্তিগতভাবে ৩০ শতাংশের বেশি জেলা শহরে ৫০ শতাংশের বেশি, উপজেলা বা থানা সদরে ১০০ শতাংশের বেশি জমির মালিক থাকা যাবে না। সব খাস জমি শুধু ভূমিহীনদের দেয়া হবে। রাষ্ট্র উদ্বৃত্ত জমি বাজার দরে কিনে ভূমিহীনদের দেবে। ভূমিহীনরা এই জমি ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু কোনভাবেই বিক্রি করে স্বত্ব হস্তান্তর করতে পারবে না। তেমন অবস্থায় সরকারের বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে এবং সেই ভূমিটি সরকার পুনরায় কোনো ভূমিহীনকে বরাদ্দ দেবে।
ভূমি ব্যবস্থা জিআইএস প্রযুক্তিনির্ভর ডাটাবেজভিত্তিক হবে। জমির রেজিস্ট্রি ও নকশা থেকে শুরু করে দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমির ডিজিটাল নকশা থাকবে। জমির বেচাকেনা, উত্তরাধিকার, বণ্টন, দান ইত্যাদি এবং সব ধরনের হস্তান্তরের রেজিস্ট্রেশন পুরোপুরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হবে। জমিসংক্রান্ত সব তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হবে এবং জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। সঙ্গে
গ) স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা : স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সমান এবং সব নাগরিকের জন্য চিকিৎসা পাবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একজন করে নিবন্ধিত ডাক্তার ও ফার্মেসি থাকার পাশাপাশি প্রতি বিশ হাজার লোকের জন্য একটি করে ৫০ শয্যার হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পৌঁছানোর জন্য টেলিমেডিসিন পদ্ধতির সহায়তা নিতে হবে। রাষ্ট্রের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা ডিজিটাল করা হবে। এটি সরকারের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের অংশ হিসেবে কাজ করলেও দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা একটি নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে। স্বাস্থ্য খাতের বিপুল তথ্যাবলি, প্রাথমিক চিকিৎসা ব্য স্বাস্থ্যসচেতনতা ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের হাতের নাগালের মাঝে দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্য ডাটাবেজ আকারে সংরক্ষিত থাকবে।
ঘ) দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান এবং বেকার, প্রতিবন্ধী, পঙ্গু, বৃদ্ধ, বিধবা ও অক্ষম ভাতা: দেশের গরিব জনগণকে দারিদ্র্যসীমার ওপর তুলে আনার জন্য খাস জমি বিতরণ, বাসস্থান, প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প, কৃষিভিত্তিক শিল্প, কুটির শিল্প এবং অন্যান্য শিল্প-ব্যবসায়-বাণিজ্য করার জন্য পুঁজি সরবরাহ, ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া এবং অন্যান্য সহায়তা দেয়া হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার আমূল সংস্কার করে একদিকে নতুন শিক্ষার্থীদের নতুন সময়ের উপযোগী কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যাতে এদের বেকারত্ব না থাকে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে বর্তমানে যেসব শিক্ষিত বেকার আছে তাদের কর্মসংস্থান করা হবে। প্রতিটি কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। যদি কোন নাগরিক রাষ্ট্রের অক্ষমতার কারণে কর্মসংস্থান না পায়, তবে রাষ্ট্র তার জন্য বেকার ভাতা দেবে। অন্যদিকে বৃদ্ধ, অক্ষম, প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্র জীবনধারণের উপযোগী ভাতা দেবে।
ঙ) সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী, জাতীয় ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা : ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য সামরিক, আধাসামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্যপ্রযুক্তিসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। দেশের সীমারেখা, ধনসম্পদসহ সব কিছুর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা বিধান করা। রাষ্ট্রের কোন নাগরিক কোন ধরনের সন্ত্রাস, হুমকি, চাঁদাবাজি, এসডি নিক্ষেপ, নির্যাতন বা রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হবে না। রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে প্রয়োজনে বায়োমেট্রিঙ্ নিরাপত্তা বিধান করবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্র ব্যক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখার নিশ্চয়তা দেবে।
অপরাধ, আইন ও বিচার : ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের প্রচলিত আইনসমূহ পরিবর্তন করা হবে এবং নতুন আইনসমূহ জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা চিন্তা করেই প্রণীত হবে। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট নতুন ধরনের অপরাধ, সাইবার অপরাধ, সাইবার কমিউনিকেশন, নিউ মিডিয়া, মেধাসম্পদ ইত্যাদি সব বিষয়কে পর্যালোচনা করে অপরাধ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধিসহ অন্যান্য আইন পরিবর্তন করা হবে। অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। প্রয়োজনমতো বায়োমেট্রিঙ্, জিন পরীক্ষা, অপরাধীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, অপরাধীর ডাটাবেজ তৈরি করা ছাড়াও বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা হবে। আইনসমূহ অনলাইনে পাবার পাশাপাশি, ডিএলআর অনলাইনে প্রাপ্য হবে। বিচারপ্রার্থী অনলাইনে বিচার প্রার্থনা করার পাশাপাশি তার মামলা কোথায় কী অবস্থায় আছে, তা অনলাইনে জানতে পারবে। আইনজীবী অনলাইনে তার বক্তব্য পেশ করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের সহায়তায় বাদী-বিবাদীর বক্তব্য বা সাক্ষ্য নেয়া যাবে।
ধর্ম-ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ক্রীড়া : রাষ্ট্র জনগণের ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটাবে। রাষ্ট্র একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা করবে অন্যদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, বা সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মকে রক্ষা করবে। তাদের তাদের নিজ নিজ ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে দিতে হবে। কারো ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মকে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা বিতরণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। ধর্ম চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তার পাশাপাশি ধর্মীয় অবকাঠামো পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তোলা হবে। অপরিকল্পিত মন্দির-মসজিদ-গির্জার বদলে পরিকল্পিত বাসস্থানের মতোই জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাসস্থান ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে ধর্মস্থান সরকারি ব্যয়ে নির্মাণ করা হবে। রাষ্ট্র প্রতিটি ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে ভিন্নমতের সহাবস্থান নিশ্চিত করবে। ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিরোধ করার পাশাপাশি সঠিক ধর্মশিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সহায়ক হবে।
রাষ্ট্রভাষাসহ সব ভাষার বিকাশ, সব সংস্কৃতির উন্নয়ন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার বাহন হবে মাতৃভাষা। তবে শৈশব থেকেই ক্ষুদ্র জাতিসমূহের জন্য বাংলা ও ইংরেজি এবং বাঙালিদের জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখতে হবে। ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি বা সংস্কৃত বা পালি শিখতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে কেবলমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে শিক্ষার বাহন। উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রভাষার পাশাপাশি ইংরেজিকে শিক্ষার বাহন করা যাবে। রাষ্ট্রের কাজকর্ম হবে শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলায়। রাষ্ট্রের সব তথ্য অবশ্যই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হবে। তবে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি বা অন্য ভাষা ব্যবহার করা যাবে। কোন অবস্থাতেই এককভাবে বিদেশি ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। আদিবাসী বা বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষাভাষী তাদের ভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করতে পারবে। সেজন্য যেসব এলাকায় বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষাভাষী রয়েছে সেসব এলাকায় বাংলার পাশাপাশি ওইসব ভাষা ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্র বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে সব ধরনের গবেষণার দায়িত্ব নেবে। তদুপরি বাংলা ছাড়া যেসব ভাষা-সাহিত্য দুর্বল তাদের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র সহায়তা দেবে। রাষ্ট্র বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশকে যে কোন ধরনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে। বিশ্বের যে কোন স্থানে বাংলা ভাষা শিক্ষার সুযোগ দেবার জন্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিটি দূতাবাসের সঙ্গে বাংলা ভাষা শিক্ষার কেন্দ্র স্থাপন করবে। রাষ্ট্র ক্রীড়া খাতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করবে এবং উপজেলা পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করাসহ নাগরিকদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের জন্য সর্বাত্মক সহায়তা করবে।
নতুন অর্থনীতি : ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির জন্য একটি নতুন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এর নাম হবে নিউ ইকোনমি বা নলেজ ইকোনমি বা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি। এটি বিদ্যমান অর্থনীতিকে প্রতিস্থাপিত করবে। অর্থনীতির চরিত্র হবে মিশ্র। এটি পুরোপুরি পুঁজিবাদী হবে না-আবার পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত হবে না। অর্থনীতি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করলেও প্রয়োজনে সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রবিশেষে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানা থাকবে, তবে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জনগণের অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে বিকশিত হতে হবে। ৫ কোটি টাকা বা তার বেশি মূলধনের কোম্পানিকে অবশ্যই পাবলিক লিমিটেড কোমপানি হতে হবে এবং শেয়ারবাজারে শেয়ার ছেড়ে জবাবদিহিমূলকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবার বা প্রতিষ্ঠান এককভাবে কোন কোম্পানির শতকরা ৫ ভাগের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। সরকার বেসরকারি খাতের কাছে লাভজনক নয় অথচ জনকল্যাণমূলক এমন খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করবে। রপ্তানি, জনকল্যাণমূলক, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও কৃষিসহ জরুরি সেবাখাত রাষ্ট্র প্রয়োজনমতো ভর্তুকি দেবে। অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই দুই ডিজিটের বা শতকরা ১০ ভাগের বেশি হতে হবে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারে উন্নীত করতে হবে। ধীরে ধীরে জিডিপির বৃহৎ অংশ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হবে। তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবা, কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, গার্মেন্টস এবং সেবাখাতের রপ্তানিকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হবে। প্রয়োজনে এসব খাতে অর্থের যোগান দেয়া হবে এবং রপ্তানি সহায়তাও করা হবে।