মাঠে মাঠে রবিশস্যের সমাহার। দিগন্তজুড়ে যতদূর চোখ যায়, শুধু সরষে খেত। এখানে শুধু হলুদ আর হলুদ রঙের মাখামাখি। যেন হলুদিয়া বরণে সেজেছে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয়, সাটুরিয়া, সিংগাইর, হরিরামপুরসহ ৭টি উপজেলার ফসলের মাঠ। হলুদিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মন আনন্দে মেতে ওঠে।
এখন মধুচাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছে তাদের বাক্সে ভরা মৌমাছি নিয়ে। প্রায় ৪০ টন মধু আহরণের টার্গেট যার আনুমানিক মূল্য ৬০ লাখ টাকা বলে আশা মৌচাষি ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। মানিকগঞ্জের দৌলতপুরসহ ৭টি উপজেলার কৃষকরা বুঝে গেছেন, মৌমাছি মধু সংগ্রহ করলে পরাগায়ণের মাধ্যমে ফসল ভালো হয়। তাই মৌসুমী মৌচাষিরা আসায় জেলায় সরষের ফলন বাড়বে প্রায় ১৫ শতাংশ।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সরষে আবাদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মৌসুমী মৌচাষিদের তৎপরতা। সরষে যেমন দিচ্ছে তেল, সঙ্গে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরষে চাষে রয়েছে দ্বিগুণ লাভ। জমির উর্বরতা শক্তি বাড়নোর জন্য এর ফুল ও পাতা থেকে তৈরি করা হয় জৈব সার। ফলে মানিকগঞ্জের অনেক কৃষকরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরষে চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
দৌলতপুর উপজেলা সদরের গ্রামের কৃষক মো. উজ্জ্বল হোসেন জানান, তার আবাদী ৩ একর জমিতে সরষে আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। গত ১০ বছর ধরে আবাদযোগ্য জমিতে সরষে চাষ করে প্রতি মৌসুমে ২০-৩০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত লাভ করছেন। চলতি মৌসুমে সরষের ফলন ভালো হলে আরও বেশি লাভের আশা করছি।
ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের রাথুরা গ্রামের কৃষক মো. কবির জানান, ভালো বীজ শনাক্ত করে সঠিক সময়ে বীজ রোপণ করলে এবং বিভিন্ন প্রকার সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে আগাম ফলন ফলিয়ে তা বাজারজাত করতে পারলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অধিক লাভ করা সম্ভব হবে। একবিঘা সরষে চাষ করতে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
ভালো ফলন হলে বিঘায় ৪-৫ মণ সরষে উৎপাদন হয়। প্রতিমণ সরষের বাজারমূল্য ১৫০০-১৮০০ টাকা। অন্যান্য ফসল চাষ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয়, তার চেয়ে সরষে চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। সরষের হলুদ ফুলের সাম্রাজ্যে মাঠে মাঠে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌচাষিরা।
জেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাতক্ষীরা, জামালপুর, গাজীপুর, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় শতাধিক মৌচাষির দল মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরষে ফুল থেকে বিশেষ কায়দায় মধু সংগ্রহ করছে। তাদের সংগৃহীত এই মধু রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্রি হয়।
প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সরষে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ চলে। এসময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫ মণ মধু আহরণ করতে পারেন। চলতি বছর জেলার বিভিন্ন স্থানে মৌচাষিরা সরষে ফুল থেকে প্রায় ৩৫ টন মধু সংগ্রহ করবেন, যার পাইকারি মূল্য ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, সাতক্ষীরা থেকে আসা মৌচাষি সাইফুল ইসলাম ও মুন্না মিয়া জানান, ৪ বছর আগে তিনি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪০টি বাক্স নিয়ে মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার বাক্সের সংখ্যা শতাধিক। সরষে ফুল থেকে তিনি মাসে ২০-২৫ মণ মধু সংগ্রহ করছেন। তিনি এই মধু ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় পাইকারি বিক্রি করেন।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই সরষে খেতে মধু সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে বসেছেন নারায়ণগঞ্জের কুমুলী ইউনিয়নের মৌচাষি দলের প্রধান মো. জসিম উদ্দিন। তিনি জানান, উন্নত প্রশিক্ষণ আর সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু সংগ্রহের কাজে ব্যাপক উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
জামালপুর জেলার মো. সেলিম ও শফিকুল ইসলাম জানান, মধু সংগ্রহ করে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার কাহিনী। তাদের বাক্সের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি। প্রতিমণ মধু ৮-১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও আশুলিয়ার এক পাইকারের কাছে।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আলীমুজ্জামান মিয়া বলেন, মানিকগঞ্জে এবার প্রায় ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরষে চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৮৮ হাজার মেট্রিকটন। সরকার বারি-১৪ জাতের বীজ সরবরাহ করায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। জেলায় ৩৫ টন মধু সংগ্রহ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসলের উৎপাদন বাড়াতেও সহায়তা করে।