আঙ্কটাডের প্রতিবেদন : ২০২৪ সালের মধ্যে ‘উন্নয়নশীল’ হবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তবে ২০১৮ সালেই প্রয়োজনীয় লক্ষ্যগুলো প্রাথমিকভাবে অর্জন করতে পারবে বলে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) প্রকাশিত এলডিসি প্রতিবেদন-২০১৬-তে এসব কথা বলা হয়েছে। আঙ্কটাডের পক্ষে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় সিপিডির রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এ তিনটি সূচকের মধ্যে কমপক্ষে দুটিতে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে হয়। এরপর আরো ৩ বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্জনগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। পরে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়ে আসার বিষয়ে অনুমোদন পেতে হবে। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এলডিসি হিসেবে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, বাংলাদেশের ২০২৭ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়ন হতে হবে সবার জন্য। যেখানে সবার অংশগ্রহণ থাকতে হবে। বঞ্চনা কমাতে হবে। আইনের শাসন ও সব মানুষের জন্য সমান সমৃদ্ধি আনতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশের সুরক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। যারা ‘গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে’ বলে বিতর্ক করছেন তারা উন্নয়নের আধুনিক ধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। কেননা, সমতা যদি না থাকে তাহলে সেটা উন্নয়ন নয় বলে জানান তিনি।

সিপিডির এই গবেষক জানান, বিশ্বের বহু দেশ এখন এলডিসি থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো- এলডিসিভুক্ত দেশগুলো যে পরিমাণ সহয়তার প্রতিশ্রæতি পেয়েছিল তা পায়নি, পেলেও ব্যবহার করতে পারেনি। এতে তারা হতাশ। অন্যদিকে যেসব দেশ সহায়তার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল, তাদের মধ্যেও অবসাদ (ফ্যাটিং) এসেছে। দ্বিতীয়টি হলো- এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশও একটি।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে। এর পরের স্তর হচ্ছে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এই স্থরে পৌঁছাতে হলে মাথাপিছু আয়কে ৪ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশের কথা বলছে, তার আন্তর্জাতিক কোনো মানদণ্ড নেই। এটা বাংলাদেশেরই তৈরি।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১৬টি দেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, ভুটান, জিবুতি, গিনি, কিরিবাতি, লাওস, মায়ানমার, নেপাল, সাও তুমে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব তিমুর, টুভালু, ভানুয়াতু ও ইয়েমেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, জিবুতি, লাওস, মায়ানমার ও ইয়েমেন ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। অন্যরা আরো আগেই এ মর্যাদা অর্জন করবে। ১৯৭১ সালে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত এই তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে জাতিসংঘ। বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে ৪৮টি দেশ। প্রতি ৩ বছর অন্তর এ তালিকা পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা দেশগুলোর জন্য বেশকিছু সুপারিশও করেছে আঙ্কটাড। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি স্বল্পোন্নত দেশ প্রবাসী আয়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। প্রবাসী আয় গরিব বাংলাদেশিদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয় উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি হাতছাড়া হলে যাতে কোনো সংকট দেখা না দেয়, সে জন্য আগে থেকেই নীতি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমিয়ে এবং অবকাঠামো খাতে বাড়তি বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি অর্জন করা সহজ হতে পারে। এটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। কারণ, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে জিএসপি ভোগ করছে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা পাওয়া ৮টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ওই বছর আফগানিস্তান সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন (৩৯০ কোটি) ডলার উন্নয়ন সহায়তা পেয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণ সুদান ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, তানজানিয়া ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, মোজাম্বিক ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন (১৪০ কোটি) ডলার, কঙ্গো ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং মায়ানমার ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। স্বল্পোন্নত কয়েকটি দেশে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ এলেও বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশে কাক্সিক্ষত বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মধ্যে অ্যাঙ্গোলায় বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৩৫২ শতাংশ। এ ছাড়া মায়ানমারে ১৯৮ শতাংশ, লাইবেরিয়ায় ৮৫ শতাংশ, নেপালে ৭৪ শতাংশ এবং লাওসে ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশ, গিনি, গিনি বিসাউ, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিয়া ও সুদানেও বেড়েছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। তবে এই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে বুরুন্ডি, কিরিবাতি, গাম্বিয়া, ভুটান ও বুরকিনা ফাসোতে।