ইচ্ছাশক্তি আর প্রচণ্ড মনোবল থাকলে মানুষ তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে সেটিই প্রমাণ করেছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার একজন নারী শিক্ষক। শাহনাজ পারভীন নামের এই শিক্ষক এখন বিশ্বের সেরা ৫০ জন শিক্ষকের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। সমপ্রতি বগুড়ার শেরপুর পৌরশহরের শান্তি নগরে শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীনের বাড়িতে কথা হয় তার সাথে।
শেরপুর উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীন এ বছরের বিশ্বসেরা শিক্ষক (বেস্ট গ্লোবাল টিচার) পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের ৫০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে আসা একমাত্র বাংলাদেশি শিক্ষক।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভারকি ফাউন্ডেশন পুরস্কারের প্রবর্তক। গত তিন বছর ধরে এ পুরস্কার প্রদান করে আসছে সংস্থাটি। সমপ্রতি ভারকি ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালের জন্য সেরা শিক্ষকদের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করে। ৫০ জনের ওই সংক্ষিপ্ত তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের সঙ্গে আছে বগুড়ার শাহনাজ পারভীনের নামও।
সংস্থার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শিক্ষকদের জন্য বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কারের তালিকায় মনোনীত করা হয়েছে তাকে।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে তৃতীয় বছরের মতো। ৫০ জনের এ সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখা যাবে সংস্থার গ্লোবাল টিচার প্রাইজের ওয়েবসাইটে (globalteacherprize.org)।
১৭৯টি দেশের ২০ হাজার মনোনীত প্রার্থীর তালিকা থেকে ৫০ জন শিক্ষককে বেছে নেওয়া হয় সর্বশেষ তালিকায়। এখানে ৩৭টি দেশের শিক্ষকরা প্রতিনিধিত্ব করছেন। আগামী বছরের ১৯ মার্চ দুবাইতে চূড়ান্ত বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
১৯৭৬ সালে বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লি দাঁড়িগাছা গ্রামে এক শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহনাজ পারভীন। পিতা মরহুম মানিক উল্লাহ ও মাতা নুরজাহান বেগম পেশায় শিক্ষক। মায়ের কর্মস্থল বগুড়ার শেরপুর পৌরশহরের উলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন। ধর্মীয় রক্ষণশীল বাবা-মা ৫ম শ্রেণি পাসের পর মেয়েকে ভর্তি করে দেন শেরপুর শহিদীয়া কামিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে ১৯৯০ সালে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে দাখিল পাস করেন। ১৯৯১ সালে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিতা-মাতার ইচ্ছার কারণেই বিয়ে হয় শেরপুর উপজেলার সাধুবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক মোহাম্মাদ আলীর সাথে। ১৯৯২ সালে শেরপুর শহিদীয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আলিম পাস করেন। এরপর কৃষিতে উচ্চশিক্ষার জন্য ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু হাল ছাড়েননি শাহনাজ। বগুড়া সরকারি আযিযুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
পিতা-মাতা ও স্বামী শিক্ষক হওয়ার কারণে এ পেশার প্রতি শাহনাজের আগ্রহ ছিল বেশি। নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ২০০৩ সালে শাহনাজ পারভীন শেরপুর উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। শুরু হয় তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ চলা । সরকারিভাবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হওয়ার ২ বছর পূর্বেই কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তিনি তার স্কুলে প্রাক প্রাথমিক ক্লাস চালু করেছিলেন। বেছে নেন সমাজের অসহায় কর্মজীবী শিশুদের।
শাহনাজ পারভীন ২০১০ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ এবং ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হবার গৌরব অর্জন করেছেন। ২০১৬ সালে তিনি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কাব লিডার হন এবং ২০১৭ সালের একুশে পদক পাওয়ার জন্য রাজশাহী বিভাগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। বিবাহিত জীবনে ২ কন্যা সন্তানের জননী। স্বামী মোহাম্মাদ আলী শেরপুর শহিদীয়া আলিয়া মাদ্রাসায় আরবী বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। বড় মেয়ে মাসুমা মরিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। ছোট মেয়ে আমেনা মুমতারিন শ্রেয়া বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।