হেমন্তের ঐশ্বর্য সুগন্ধমধুর ফুল স্বর্ণ অশোক। কাঁচা সোনা রঙের মনকাড়া পুষ্প।
ভূ-বাংলায় তাকে দেখে আসছি বলধা গার্ডেনের দক্ষিণের বাগানে—একমাত্র স্বর্ণ অশোক, অপরাজেয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বলধার দক্ষিণ-পুব কোণের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে ডালের আগায় ফুলের মুকুট মাথায় চিত্রিত হয়ে আছে। হেমন্তের এই ভরা ঋতুতে। রাস্তা থেকে দ্রষ্টব্য হয়ে আছে রাজকুমারীর মতো। যেখানে-সেখানে তার থাকা শোভনীয় নয়, থাকতে পারে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ও জাতীয় স্মৃতিসৌধে। এমন ঘনসন্নিবিষ্ট ডালপালা ও পত্রশোভিত দ্রুম খুব কমই দেখা যায়। আর স্বর্ণ অশোক, রাজ অশোক ও অশোক কখনো পত্রশূন্য হয় না।
প্রাচীন গ্রন্থের কাহিনীতে আছে মহান পুরুষ মহেশ্বরকে পাওয়ার জন্য উমা কঠোর ধ্যানে বসেছেন। মা তখন মেয়েকে বারণ করেছিলেন তপস্যায় বসতে। উ অর্থ বাছা, মা অর্থ তপস্যায় যেয়ো না, সেই থেকে মেয়ের নাম উমা। আর তপস্যা করেছিলেন অশোক বৃক্ষের নিচে বসে। তপস্যায় তার শোক দূর হয়েছিল বলে গাছটির নাম হয় অশোক। আর কবিরাজের বিধান অনুযায়ী বন্ধ্যা নারী অশোকের কুঁড়ি খেয়ে সন্তানবতী হয়। আবার বন্ধ্যা অশোক বৃক্ষে যুবতী পদাঘাত করলে ফুল ফোটে।
অশোকের কথা উঠলেই আমাদের মন চলে যায় সেই প্রাচীন লঙ্কায়। রাজা রাবণ সীতাকে হরণ করে লঙ্কার রাজপুরীর অশোক কাননে বন্দিনী করে রেখেছিলেন। সীতা অশোক গাছের নিচে একাকী নতমুখী এবং অশ্রু ভরাতুর। অশোক গাছে হনুমান, কাননের পাহারা দিচ্ছে রাবণের আদেশবাহী দুরন্ত চেড়ী রাক্ষসীরা।
হেমন্তে স্বর্ণ অশোক, বসন্তে রাজ অশোক ও অশোক পুষ্পিত হয় সৌন্দর্যে প্রতিযোগী হয়ে। স্বর্ণ অশোকের সোনার বরণ তনু শিহরণ জাগানিয়া, বাসনা উদ্রেককারী ও মধু-যাতনা সৃজনশীল। এই স্বর্ণবর্ণ ফুলের রাজ্যে স্বর্ণ অশোকের পরে আছে কদম, নাগকেশর, গামারি, ঘ্রাণসম্রাজ্ঞী চা ফুল, স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা বা মুচকুন্দ এবং স্বর্ণচূড়া (বা হলুদ কৃষ্ণচূড়া)। ওদের সবার গায়ে রোচন সুগন্ধ নেই। স্বর্ণ অশোক দিতে পারে সৌরভ এবং বড় খোঁপায় ঐশ্বর্য ও ভালোবাসার আমন্ত্রণবার্তা। আর সম্মোহন।
শরৎ-হেমন্তে প্রধান ফুল শিউলি। সারা বছর ফোটা শিউলিও আছে সোনার বাংলায়। স্বর্ণ অশোকের এমন বৈশিষ্ট্য যে সব সময় সে উন্নত গ্রীবা বা সুদূরের পিয়াসি। মাঠে মাঠে হৈমন্তী সোনার ধান, অতিথি পাখির কলহংসধ্বনি আর নবান্ন ও পিঠেপুলির সুবাস। প্রকৃতিই বাঙালিকে এই শিক্ষা দিয়ে চলেছে ঋতুতে ঋতুতে, আবহমানকাল ধরে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে।
বহু শাখাবিশিষ্ট ছায়াতরু অশোক। বলধার এই স্বর্ণ অশোক প্রায় শতবর্ষী, ২৫-৩০ ফুট উন্নত। ডাঁটায় প্রায় ছয় জোড়া পাতা। ৯ ইঞ্চি লম্বা, চওড়ায় এক-দেড় ইঞ্চি। তামাটে কচিপাতা ভর্তা হিসেবে সুভক্ষ। আম, জাম, সব রকম লেবু, অশোক, কচি কলমি, শর্ষে, বেলপাতা থেকে নিম-তুলসী; থানকুনি থেকে কচুপাতা কিছু বাদ নেই আমার খাদ্য তালিকায়।
স্বর্ণ অশোকের পাতার মতো ফুল ও ছালও ঔষধি গুণে ভরপুর। ঔষধে, কাব্যে, সৌন্দর্যে অশোক অপ্রতিদ্বন্দ্বী। হেমন্তের শেষ থেকে শীতভর স্বর্ণ অশোক সোনার আভা ও সৌরভ ছড়াবে। বিজয়ের বার্তা প্রবহমান রাখবে উন্নত শিরে।