মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লেনদেন এখন অনেকটাই প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এদিকে জঙ্গি অর্থায়নের অন্যতম পরিবাহী মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাঙ্কিং। মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গি অর্থ লেনদেন বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাদা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। জঙ্গি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গি অর্থায়নের উৎস এবং হোতাদের নিয়ে কথাবার্তা চলছে। তবে জঙ্গি অর্থ জোগানদাতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। জঙ্গি-সন্ত্রাসে উল্লেখযোগ্য কোনো বড় অর্থায়নকারী ধরা পড়ার খবর এখনও মেলেনি। জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে বড় কর্পোরেট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদদের নামে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক অনুষ্ঠানে জানান, জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে রাজনীতিবিদদের নামে। তবে কোনো নাম সুনির্দিষ্ট না করে তিনি বলেন, অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। তথ্য প্রমাণসহ তাদের গ্রেফতার করা হবে।
মোবাইল ব্যাঙ্কিং : জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সর্তকর্তা দেখানোর জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে কিছু অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। এই অ্যাকশন প্লান বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনা পালনে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাঙ্কিং লেনদেনে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন যথাযথ পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি দেশের ২৮টি তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তাদের (ক্যামেলকো) সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএফআইইউ। বৈঠকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্যাংকগুলোকে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সর্তকর্তা দেখানোর জন্য বলা হয়েছে।
জঙ্গিরা কিভাবে অর্থ লেনদেন করছে, কারা এর মদদদাতা, ব্যাঙ্কিং চ্যানেলে এসব অর্থ লেনদেন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য বিএফআইইউকে নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠকে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাঙ্কিং ব্যবহার করে সন্দেহজনক লেনদেনের বেশি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। মোবাইল ব্যাঙ্কিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে অধিক সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় সব ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনলাইন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা হলেও অনলাইনের আওতায় সরকারি মালিকানাধীন সব ব্যাংক এখনও আসেনি। অটোমেটেড করা হয়নি বীমা কোম্পানিগুলোর লেনদেন। এছাড়া মুদ্রা কেনা-বেচায় নিয়োজিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সধারী অনেক মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের লেনদেন এখনও অনলাইনের আওতার বাইরে।
এদিকে কোনো লেনদেন নিয়ে সন্দেহ হলে বিদ্যমান আইনে তাৎক্ষণিকভাবে বিএফআইইউকে তথ্য দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অনেক ব্যাংক তা করে না। যে কারণে পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিদর্শনে সন্দেহজনক লেনদেনের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। আগামীতে যেন কোনোভাবে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অন্যান্য ব্যাংকের অনলাইন সংযুক্তি থাকায় অবৈধ লেনদেনকারীদের শনাক্ত করা সহজ হয়। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় এ পদ্ধতি না থাকায় বিদেশ থেকে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় কিছু কিছু অর্থ চলে আসছে। এ সুযোগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী ব্যাংক, এনজিও, মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা এনে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কাজে ব্যয় করছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব লেনদেনকারীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, ১৯৮৯ সালে প্যারিসে জি-৭-এর রাষ্ট্রপ্রধান এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের প্রভাবশালী আট দেশের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। জি-৭ সামিট থেকে ঘোষণা করা হয় বিশ্বজুড়ে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতকে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংয়ের হুমকি থেকে রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদে অর্থায়ন প্রতিরোধে এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সুরক্ষার জন্য ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিংয়ের (এফএটিএফ) ৪০টি সুপারিশ আছে। তখন থেকেই আমরা এ কারণে এই সুপারিশগুলো আমরা কঠোরভাবে মেনে চলার চেষ্টা করছি।
কঠোর অবস্থানে সরকার : জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। জঙ্গিদের যারা অর্থ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গি হামলা হলেও সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি সামনে আসায় সরকারের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে সম্প্রতি বেশ কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন এনজিও অর্থের বড় জোগানদাতা। এ ছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ব্যবসায়ীরাও অর্থায়ন করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, অর্থদাতাদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করা গেছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশের ভেতরে ও বাইরে বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগে ২০১৫ সালের আগস্টে বিএনপি নেতা ও সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ তিন আইনজীবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক জঙ্গিগোষ্ঠী হামজা ব্রিগেডের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া এই আইনজীবী গত ২২ ফেব্রুয়ারি জামিন পেয়েছেন। এর বাইরে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকার। জঙ্গিবাদে অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধানের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড জঙ্গিবাদে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করলেও সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি। তবে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ৩৫টি ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করে রেখেছে।
এই একাউন্টগুলো সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়ে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত বাংলাদেশি জঙ্গি সাইফুল হক সুজন ও তার আত্মীয়স্বজনের। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্তে জানতে পারে, বিভিন্ন দেশ থেকে সুজন ও তার ঘনিষ্ঠদের একাউন্টে ২ কোটি ২২ লাখ টাকা আসে। পরে ওই টাকা যুক্তরাজ্য হয়ে সিরিয়ায় আইএসের জঙ্গিদের কাছে পাঠানোর অভিযোগে একাউন্টগুলো জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা দেশের বাইরে সেকেন্ড হোম করছে, প্রটেকশন মানি রাখছে। এসবের উৎস খুঁজে বের করা উচিত। অথচ কিছুই হচ্ছে না। অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আমরা সতর্ক হচ্ছি। সতর্কতা আগে থেকে জরুরি। তিনি আরও বলেন, একা সরকার বা সাধারণের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, অর্থদাতাদের অনেককে চিহ্নিত করা গেছে। এছাড়া জঙ্গি অর্থায়নে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দেশের ভেতরে ও বাইরে বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
আইন আছে তবুও : জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশে তিনটি আইন থাকলেও এসব পুরনো আইন জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে তেমন কার্যকর নয়। আইনগুলো হচ্ছে মানি লন্ডারিং বা মুদ্রাপাচার, ট্রান্সফার প্রাইসিং ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব, তদন্তে দুর্বলতা ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এসব আইনের সুফল খুব একটা মিলছে না।
পরিসংখ্যানের তথ্যনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন সত্ত্বেও ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির সর্বশেষ (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ ব্যয় হয় জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। সে জন্য বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এখন জঙ্গি অর্থায়ন কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা চলছে। এ কারণে ২০১২ সালের সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইনটি গত বছরের আগস্টে সংশোধন করে আরও কঠোর করেছে সরকার। সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে প্রথম আইন করা হয় ২০০৯ সালে। সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। অন্যদিকে মানি লন্ডারিং বা মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইন করা হয় ২০০২ সালে। পরে ২০১২ এবং সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে হালনাগাদ করা হয় এটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বর্তমানে যে আইনি কাঠামো রয়েছে সেগুলো মেনে চললে জঙ্গি অর্থায়নের সুযোগ নেই। পাশাপাশি মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের প্রাত্যহিক লেনদেনকে আরও সংঘবদ্ধ কাঠামোয় পরিচালনা করা উচিত। হোটেলের মত প্রতিদিনের বিকাশসহ অন্য মোবাইল ব্যাঙ্কিং লেনদেনের তথ্য পুলিশের কাছে পাঠানো উচিত। এ জন্য পুলিশে আলাদা বিভাগ খুললে খারাপ হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে নানা উপায়ে টাকা স্থানান্তরের সুযোগ রয়েছে। যার সব কিছু বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে আর্থিক খাতের কড়া নজদরদারী ও সতর্কতার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডের গতি কমাতে হলে আগে তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অর্থায়নের উৎস বন্ধ হলে জঙ্গিদের কাঠামো ভেঙে পড়তে বাধ্য।