আলোর পথযাত্রী মধুপুরের নির্মলা

নারীর হাত ধরে যাত্রা শুরু কৃষির। কৃষিজ শস্য ও প্রাণীর অধিকাংশই বুন্যে নয়; সুনির্দিষ্টভাবে মানুষ জাত নির্বাচন করে তা উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। সূচনা থেকে এভাবে বিকশিত হচ্ছে কৃষি। কৃষি বিকাশিত ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার একটি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের শস্য ও প্রাণীজাত নির্বাচন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার দিকে ও নজর দিয়েছে। ক্রমান্বয়ে গবেষণার কারণে মানবসমাজ এখনও পৃথিবীর সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাবার উৎপাদনের জন্য সাফল্য অর্জন করে চলেছে। জনসংখ্যার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তার খাদ্য নিরাপত্তা। এ চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন কৃষি প্রতিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্যময় একটা নির্মল মন। প্রকৃতি বাঁচাতে হলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন প্রকৃতিপ্রেমী একটা স্বচ্ছ মনের। এ মনের আয়নায় দেখতে প্রকৃতির অপরূপ ছবি। আঁকতে হবে মাটির বুকে সবুজের শ্যামল মানচিত্র। আর সে মানচিত্রে ফোঁটে ওঠবে কৃষি প্রতিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। এমনি একজন সৃজনশীল গারো সমপ্রদায়ের নারী নির্মলা হাদিমা। তার বয়স ৬০ বছর। তিনি তিলে তিলে গড়ে তোলেছেন নিজ গ্রাম মধুপুরের বনবনানী ঘেরা শালবনের পল্লী প্রকৃতির অপরূপ মায়াময় ছায়াময় ঘেরা পেগামারীতে ভেষজ মিউজিয়াম। প্রায় ২ একর জমিতে গড়ে ওঠা ভেষজ উদ্ভিদের বাগানে রয়েছে বিরল দুর্লভ প্রজাতির ৫/৬শ’ জাতের বৃক্ষলতা। তার ভেষজ মিউজিয়ামের নাম দিয়েছেন নক্মান্দি। নক্মান্দি হচ্ছে মান্দি ভাষা। এর অর্থ হচ্ছে মান্দি আদিঘর। বাঁশের মাচার ওপর ছনের ছাউনি দিয়ে তোলা ঘর। এ ঘরের চারপাশে বাঁশ চটাই দিয়ে বেড়া দেয়া। ঘরের ভেতরেই চলে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি পর্ব। ঘরে থাকে তাদের ব্যবহার্য নানা প্রকার জিনিসপত্র। মধুপুর শহর ১০ কিমি দূরে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ মহাসড়কের দোখোলার পেগামারী নক্মান্দিতে গিয়ে জানা যায় গারো সমপ্রদায়ের নারী নির্মলা হাদিমার ঔষধি উদ্ভিদ ও পরিবেশ সংরক্ষণের নানা কাহিনী। এক সময় অভাবের তাড়নায় নির্মলা সংসারের কাজ ও আলু তোলে চলত তার জীবন জীবিকা। অভাব আর দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন তিনি। চোখে মুখে ছিল অমানিশার কালো অন্ধকার। ভাতের জন্য হাহাকার। আলুই ছিল তার খাদ্য তালিকার অন্যতম খাদ্য। যদিও তাদের আলু তোলে খাওয়া সংস্কৃতিরই একটা অংশ। এভাবে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েন। টেলকি বাজারে দেখা হয় রবি খাঁন নামের এক প্রকৃতিপ্রেমীর সাথে। আলাপের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তারা ঔষধি বৃক্ষ চাষ করবে। একেবারে শূন্য হাতে শুরু করলেন মধুপুর বন থেকে বিরল প্রজাতির ঔষধি বৃক্ষ, লতা, গুল্ম সংগ্রহ করা। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে তাদের পরিকল্পনা। রবি খাঁনকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেন নির্মলা। পরে রবি খাঁনের ‘সেম্প’ (সোসাইটি ফর প্রটেকশন অব মেডিসিনাল প্ল্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট) ঔষধি উদ্ভিদ ও পরিবেশ সংরক্ষণ সমাজ নামক এ সংস্থা থেকে ট্রেনিং নিয়ে শিখেন গাছ পরিচিতি যত্ন নেয়া। মনে জাগে স্বপ্ন। বুকে আসে আশা। এভাবে স্বামীর রেখে যাওয়া জমির ২ একর জুড়ে গড়ে তোলেছেন বিশাল ভেষজ বৃক্ষের বাগান। প্রতিদিন তার বাগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী ও গবেষকরা আসেন। তার বাগানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে চারপাশে নানা প্রকার ঔষুধি বৃক্ষের সমারোহ। প্রবেশদ্বারে টানানো হয়েছে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে না জেনে, না শুনে, কোন গাছের পাতা, ফুল, ফল খাবেন না। কারণ প্রতিটি বৃক্ষেরই গুণাগুণ ভিন্ন। তাই ক্ষতি হতে পারে এজন্য সতর্ক করা হয় দর্শনার্থীদের। পুরো বাগান যেন সৃজনশীলের মেলা। বিধাতা যেন নিজ হাতে এসব বৃক্ষ সাজিয়ে দিয়েছেন। বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের নির্মলা গাছের নাম বলে দেন। বাগানে ঘুরে মন জুড়িয়ে যায়। নির্মলা হাদিমা জানান, অনেক কষ্ট করে ‘সেম্প’ এর চাষী হয়ে আমি এ কাজটি করেছি। এখন আমার অভাব নাই। আর কষ্ট করতে হয় না। প্রতি মাসে ১০/১৫ হাজার টাকা আয় আসে। তিনি জানান, আয়ুরবের্দিক কোম্পানি তার বাগান থেকে সরাসরি কাঁচামাল কিনে নেয়। নগদ টাকা পান। তিনি আরো জানান, প্রকৃতি নিয়ে সবসময় ভাবি।