বর্তমানে দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া।
দেশের সব মানুষ ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে। যেখানে গ্রিড পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেখানে বিকল্প পদ্ধতির নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।
‘জাতীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সপ্তাহ ২০১৬’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় গতকাল বুধবার এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) এ আয়োজন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব মানুষের ঘরেই আমাদের আলো পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা সেই অঙ্গীকার করেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের চলমান গতি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে আমাদের রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে পারব। এ কাজের অংশ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। ’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি ব্যবহারে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক কষ্ট করেই কিন্তু আজ আমরা এ জায়গায় এসেছি। কাজেই এখানে সবাই একটু সাশ্রয়ী হবে, সেটাই আমি আপনাদের আহ্বান জানাব। আমরা কিন্তু অনেকভাবে বিদ্যুতের অপব্যবহার করি। কাজেই এ ক্ষেত্রে আমি চাই—অভিভাবক, শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই; যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিস-আদালত, সব ক্ষেত্রেই আপনারা যদি একটু সাশ্রয়ী মনোভাব নেন, সবাই যেন একটু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হন; অর্থাৎ বিদ্যুতের সুইচটা একটু নিজেরাই অফ করেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আমার কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় লাইট ও ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে বের হই। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। যেটা আমার কাজ সেটা তো আমাকেই করতে হবে। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে আমরা যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করি তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ রেখে আসি চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় পেয়েছি তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট। তার মানে বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে বিদ্যুৎ উৎপাদন তো বাড়েইনি, বরং কমেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ খাতের ক্রমাগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গত আট বছরে ৮০টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে মোট সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ৯ হাজার ৮৯৩ সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের পরিমাণ তিন লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার।
বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণেও সরকার ব্যাপক কার্যক্রম নিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘উৎপাদিত বিদ্যুৎ সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্নভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে আট বছরে এক হাজার ৯০২ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন ও ৯৭ হাজার কিলোমিটার নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে ৯ হাজার ৮৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি কয়লাভিত্তিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এ ছাড়া আমরা রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সই করেছি। ২০২৪ সাল নাগাদ কেন্দ্রটি থেকে দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ’
২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত নতুন তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্যাসের গড় উৎপাদন দৈনিক এক হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বেড়ে বর্তমানে দৈনিক দুই হাজার ৭৪০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। নতুন ৮৫৪ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, সার কারখানা, শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতে বর্তমানে প্রায় ৩৪ লাখ গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক তিন হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে অফগ্রিড এলাকার ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, যা সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকে গুরুত্বারোপ করে সরকার গত আট বছরে বেশ কিছু চুক্তি সম্পাদন করেছে। বাংলাদেশ-ভারতের সহযোগিতা চুক্তির আওতায় বর্তমানে ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে এবং আরো ৫০০ মেগাওয়াট আমদানির কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। মহেশখালীতে বিল্ড-অউন-অপারেট-ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে একটি ‘ফ্লটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কাজ বাস্তবায়নাধীন আছে।
২০১৮ সালে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে দিনে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিশন-২০২১-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কয়েকটি ল্যান্ড বেসড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রাহক সেবার মানও বাড়বে।
চার দিনব্যাপী বিদ্যুৎ, জ্বালানি সপ্তাহ উপলক্ষে আইসিসিবিতে মেলার আয়োজন করা হয়েছে, তা চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত। গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দৈনিক জনকণ্ঠর সিনিয়র রিপোর্টার রশিদ মামুনকে সেরা পত্রিকা রিপোর্টিং পুরস্কার তুলে দেন। আর এ বছর সেরা ইলেকট্রনিক রিপোর্টিং পুরস্কার পেয়েছেন দ্য ইনডিপেনন্ডেট প্রত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক শাহেদ সিদ্দিকী।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অন্যান্যের মধ্যে নেপালের জ্বালানিমন্ত্রী জনার্দন শর্মা, জাতীয় সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম, জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম বক্তব্য দেন।