আর্থিকভাবে আমাদের নারীরা সাবলম্বী না হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, কারণ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীদের আর্থিক সচ্ছলতা প্রয়োজন। দেশের চাকরির বাজারে শতভাগ নারীর চাকরির সুযোগ নেই। সবাই চাকরির পেছনে ছুটবে, সেটা ভাবারও সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসা নারী উদ্যোক্তাদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হতে পারে। যদি কোনো নারী ব্যক্তিমালিকানাধীন বা প্রোপাইটরি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রোপ্রাইটর হন কিংবা পার্টনারশিপ বা জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার অন্যূন ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক হন, তবে তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হবেন।
দেশের বর্তমান উন্নয়নের গতিধারাকে ত্বরান্বিত করতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অর্থায়ন-সংক্রান্ত সংশোধিত মাস্টার সার্কুলারে এসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশেষ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী শিল্পোদ্যোক্তাদের সব প্রকার ঋণ আবেদন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিটি শাখায় স্বতন্ত্র ‘ওমেন এন্টারপ্রেনারস ডেডিকেটেড ডেস্ক/হেল্প ডেস্ক’ স্থাপন ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে তাদের এসএমই খাতে অর্থায়নে সহায়ক এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ওই হেল্প ডেস্কের প্রধান হিসেবে সম্ভব হলে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টিকে জামানত হিসেবে বিবেচনা করে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রদত্ত ঋণ সুবিধা সহায়ক জামানত ব্যতিরেকে ঋণ দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে গ্রুপ জামানত কিংবা সামাজিক জামানত গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। গ্রুপ বা কাস্টারভিত্তিক ঋণ বিতরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের গ্রুপভিত্তিক এসএমই ঋণ বিতরণ করতে হবে। বাংলাদেশের মানচিত্রে সদ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়া (সাবেক ১১১টি ছিটমহল) অঞ্চলের বাসিন্দাদের জাতীয় অর্থনীতিতে মূলধারায় সংযুক্ত করা এবং তাদের সম্ভাবনাময় উদ্যোগ বিকশিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান এসএমই নীতিমালার আলোকে এ অঞ্চলের কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের গ্রুপভিত্তিক এসএমই ঋণ বিতরণের আওতাভুক্ত করতে হবে। গ্রুপের সদস্য সংখ্যা, গ্রুপভিত্তিক ঋণের পরিমাণ, ঋণগ্রহীতা নির্বাচন, ঋণ মঞ্জুরি, দলিল সম্পাদন বিষয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনস, ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিধিবিধান ও ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন বিষয়ে পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন, প্রচার ও পরিপালন করবে। সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শাখা কর্তৃক শাখার আওতাধীন ন্যূনতম তিনজন উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী নারী কিংবা নারী উদ্যোক্তাকে খুঁজে বের করতে হবে, যারা ইতিপূর্বে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেননি। তবে এই সংখ্যা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট শাখা প্রশংসিত হবে। নির্বাচিত নারী উদ্যোক্তাদের তাদের পছন্দ অনুযায়ী শিল্প-ব্যবসা-সেবা কার্যক্রম নির্বাচন, মূলধন সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় পরিচালনা, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বা সেবা বাজারজাতকরণ, ব্যাংক হিসাব খোলা, লেনদেনের পদ্ধতিসহ সার্বিক বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে কিংবা যৌথভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক ঋণ কার্যক্রমের অতিরিক্ত হিসেবে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি এলাকা কর্তৃক নির্বাচিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিনজন নারী উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে প্রতিবছর ন্যূনতম একজনকে এসএমই খাতে ঋণ দিতে হবে। এ সংখ্যা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট শাখা প্রশংসিত হবে। নতুন নারী উদ্যোক্তাদের প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে বিধি মোতাবেক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বাজেট ছিল ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার মোতাবেক, মোট এসএমই ঋণের মধ্যে এসএমই নারী উদ্যোক্তা ঋণের কাক্সিক্ষত হার হবে ন্যূনতম ১০ শতাংশ। আগামী পাঁচ বছরে এই হার ১৫ শতাংশে উন্নীত করার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। জাতীয় শিল্পনীতিতেও শিল্পায়নে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ও বিকাশের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের প্রাক-বিনিয়োগ পরামর্শ, প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন ও উদ্বুদ্ধকরণে সহায়তাদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিসিক, বিটাক, এসএমই ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহায়তা করবে। নারী শিল্পোদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি খাতের সব প্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দেবে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্প খাতে শিল্প স্থাপন ও পরিচালনায় নারী শিল্পোদ্যোক্তারা যাতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে জন্য প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। নারী শিল্পোদ্যোক্তা ও তাদের সহায়তাদানকারী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এজেন্সিগুলোর মধ্যে তথ্য ও অভিজ্ঞতার ব্যাপক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। নারীর ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, বিশেষ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নারীর অংশগ্রহণ ক্ষেত্রে যেসব আইনগত বাধা রয়েছে, সেসব বাধা চিহ্নিতকরণপূর্বক অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বিশ্বে বাংলাদেশ যে অবস্থান করে নিয়েছে সেটা নারীর ক্রমাগত অগ্রসরতাকে ঘিরেই সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘ ‘দ্রুত এগিয়ে চলা’ ১৮ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদপে। প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। তবে শিক্ষার হার কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে, ব্যবসায়িক কর্মকা-ে তাদের অংশগ্রহণ সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ছোট এই দেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি। সমস্যাও রয়েছে। তবে উদ্যোগ নিলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন সঠিকভাবে নীতিমালার বাস্তবায়ন। দেশের প্রয়োজনেই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণের জন্য।