তরুণদের দেশপ্রেম হৃদয়ে আশা জাগায়: হারুন হাবীব

‘শেকল দিয়ে বাঁধা ১৫ থেকে ২০ বছরের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। বিস্ফোরকে উড়ে গেছে দেহের নিম্নাংশ। আর বাকি অংশে কুকুরের মহোৎসব।’- এটি একাত্তরের জামালপুর। ছবির আলোকচিত্রী গেরিলা যোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব। তার ভাষায়, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এক মধ্যদুপুরে রাইফেল রেখে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম ছবির খোঁজে। শহরের একপ্রান্তে কুকুরের জটলা দেখে এগিয়ে যেতেই চোখ ফেটে জল বেরুলো কয়েকফোঁটা। হাতের এক পিঠ দিয়ে চোখ মোছে কয়েকটি ক্লিক…। হারুন হাবীবের তোলা এরকম ৫০টি ছবি রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। যুদ্ধেরদিনের নির্মমতার সাক্ষী এই ছবিটি সুদীর্ঘ ৪৫ বছর পরেও মানুষকে কাঁদায়। ফিরিয়ে নিয়ে যায় বাঙালির গৌরব আর দুঃখগাথার ইতিহাস মহান একাত্তরে।
ভোরের কাগজের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, কামালপুর রণাঙ্গন (বর্তমানে এটি জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত) ছিল মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল। এ রণাঙ্গনে শত শত মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছে। ৯ মাসের পুরো সময়ই এ রণাঙ্গনে যুদ্ধ হয়েছে। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল তাহের পা হারিয়েছিলেন এ কামালপুর রণাঙ্গনে। দিনটি ছিল ১৪ নভেম্বর। আমরা কখনো পাকিস্তানের দুর্ভেদ্য এ ঘাঁটি দখল করতে পারিনি। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম অংশে বিমান আক্রমণ চালানোর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা থেকে নয়াদিল্লি পৌঁছেই যৌথ কমান্ড গঠন করেন। ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন নামে তখন রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে যায় যুদ্ধের গতি প্রকৃতি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য সীমান্ত
অতিক্রম করে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে শরিক হন। আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় নতুন আশার আলো। কর্নেল তাহের আহত হওয়ার পর আমাদের সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন ক্যাপ্টেন আজিজ। ৪ ডিসেম্বর সকালে ঠিক করা হয়, যেভাবেই হোক আজ কামালপুর আক্রমণ এবং দখল নেয়া হবে। সেদিন ব্রাহ্মণপাড়ায় এসে জমা হয় শত শত মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর সদস্য। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হলো কে সারেন্ডার লেটার নিয়ে কামালপুরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যাবে? আমাদের এলাকার একটি ছেলে বশির আহমদ (বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) অসম সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর পূঁতে রাখা মাইনের পরোয়া না করে সাদা পতাকা ও চিঠি নিয়ে যায়। আমাদের ক্যাম্পটা ছিল ভারতীয় সীমান্তের কাছেই। ফলে সব কিছু দেখা যাচ্ছিল। এক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও বশির বা পাক সেনাদের কারো না আসার কারণে আমাদের উৎকণ্ঠা আরো বাড়ছিল। এরপর আনিসুল হক সঞ্জু নামে একটি ছেলে একইভাবে আরেকটি সারেন্ডার লেটার নিয়ে গেল। ভারতীয় এক কর্নেলের স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোমরা আত্মসমর্পণ না করলে আমরা এয়ার স্ট্রাইক করব। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ করছিল না এবং আমাদের দুই মুক্তিযোদ্ধার খোঁজও জানতে পারছিলাম না। দুইঘণ্টা অপেক্ষার পর মিত্রবাহিনীর অনেক বিমান এসে কামালপুরের ওপর বোমাবর্ষণ করে। তার বেশ কিছুক্ষণ পর (সম্ভবত) ক্যাপ্টেন আসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তান নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য এবং রাজাকারসহ মোট ১৭০ জন সারিবদ্ধ হয়ে হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসে। তাদের আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি আমার স্মৃতিতে এখন ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
কামালপুর মুক্ত হওয়ার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে উল্লেখ করে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব বলেন, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর তাদের দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ছুটে এলো। আমরা কামালপুর গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলাম। দেখি ডজন ডজন মেয়েকে তারা ঘরের মধ্যে ধরে রেখেছে। বহু বাঙালিকেও তারা বেঁধে রেখেছে ঘরের মধ্যে। আমরা তাদের সবাইকে ছেড়ে দিলাম। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো আমরা উদ্ধার করলাম। তারপর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী মিলে বকশীগঞ্জের দিকে এলাম। বকশীগঞ্জে এসে দেখি চারদিকে পোড়া বাড়িঘর। মানুষজন ভীতসন্ত্রস্ত। তারপরও মানুষ জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। তাদের মধ্যে ফুটে উঠেছে আশার আলো। ৬ ডিসেম্বর আমরা চলে এলাম শেরপুরে। শেরপুর তখন ছিল হিন্দুপ্রধান অঞ্চল। সেখানে এসে দেখি হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। এ অত্যাচার করেছিল মূলত রাজাকার-আলবদররাই। আমরা চারদিকে মার্চ করে পুরো শহর দখল করে ফেললাম। এরপর অগ্রসর হলাম জামালপুরের দিকে। কারণ জামালপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনো রয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের একপাশে শেরপুর এবং অপর পাশে জামালপুর শহর। নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের ওপর শেলিং করছিল। শেলিং করতে করতে তারা চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছিল ঢাকার দিকে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের পক্ষে আর সেখানে থাকা সম্ভব নয়। ৬-১০ তারিখ পর্যন্ত আমরা ব্রহ্মপুত্রের চরেই থাকলাম। ১০ ডিসেম্বর আমরা ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা এবং শেরপুর মুক্ত করি।
গেরিলা যোদ্ধা হারুন হাবীব রাইফেল কাঁধে নিয়ে যুদ্ধ করার পাশাপাশি কাজ করেছেন যুদ্ধকালীন সংবাদপত্র ‘জয়বাংলা’ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরল অনেক মুহূর্তের ছবি তুলেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া প্রসঙ্গ তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। ১১ নম্বর সেক্টর টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা (বর্তমানে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ) এবং গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের একটা বড় অংশ নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আমি ওই সেক্টরের প্রধান সদর দপ্তর মহেন্দ্রগঞ্জে ছিলাম। তার ভাষায়, আমি কখনো পেশাদার ক্যামেরাম্যান ছিলাম না, আজও নই। কিন্তু এরপরও ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক রণাঙ্গনের কিছু ছবি তোলার গর্ব নিতে পেরেছি। এটা সত্যিই আমার সৌভাগ্য।
বিজয়ের পরে ঢাকায় ফিরেন হারুন হাবীব। ওই সময়ের ভুতুড়ে ঢাকার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমি ঢাকায় ফিরেছি ডিসেম্বরের ২১/২২ তারিখে। ট্রেনযোগে। ট্রেন চলছিল খুব আস্তে আস্তে। কারণ পূঁতে রাখা মাইনের ভয় ছিল তখন। ট্রেনে ঢাকায় আসতে তখন ৪-৫ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। ট্রেনে আসার দৃশ্যটাও ছিল অভূতপূর্ব। টিকেট করার কোনো ব্যাপার কিংবা সুযোগ তখন ছিল না। ট্রেনে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় সৈন্য এবং বাস্তুহারা লোকজন। মুক্তিযোদ্ধারা যে যেখানে পারছে ট্রেনে উঠছে, আবার নামছে। জয় বাংলা স্লোগানে গোটা ট্রেন ছিল মুখরিত। যুদ্ধে যাওয়ার আগে আমি থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০৭নং কক্ষে। গিয়ে দেখি কেউ নেই। সব রুম তালাবদ্ধ। পুরান ঢাকায় নীলাম্বর সাহা রোডে আমার দূরসম্পর্কের এক চাচাতো বোনের বাড়ি ছিল। সেখানে গেলাম। অন্য আত্মীয়-স্বজনদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে আমার বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর ঢাকা শহর আনন্দে মুখরিত হলেও সেই সময় ঢাকা শহরকে মনে হচ্ছিল আতঙ্কিত একটা শহর।
মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন সময়ের এই সাহসী সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা থেকেই বললেন, মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। স্বাধীনতা বিরোধীদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার আগে এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়। তবে ৪৫ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা দিবসের মতো ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের কবলে পড়ে ২১ বছর এবং ইতিহাস বিকৃতির অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথে যাত্রা করেছে বাংলাদেশ। ৪৫ বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমকে আশা জাগানিয়া হিসেবে দেখছেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রজন্মের মধ্যে আদর্শের চেতনাবোধ জেগেছে। এটি অত্যন্ত শুভলক্ষণ। কারণ তরুণরাই জাতির আশার বাতিঘর। একাত্তরেও বাংলাদেশ হারেনি, পথ হারাবে না প্রজন্মের বাংলাদেশও।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধা ও রণাঙ্গন সংবাদদাতা হারুন হাবীবের জন্ম ১৯৪৮। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে স্নাতকোত্তর। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। বর্তমানে ‘জার্নালিজম এন্ড পিস ফাউন্ডেশন’ জেপিএফের নির্বাহী পরিচালক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- উপন্যাস : সোনালি ঈগল ও উদ্বাস্ত সময়, পাঁচপুরুষ, প্রিয়যোদ্ধা, গল্পগ্রন্থ : ছোটগল্পসমগ্র ১৯৭১, গল্পসপ্তক, বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী, লালশার্ট ও পিতৃপুরুষ, স্বর্ণপক্ষ ঈগল, মুক্তিযুদ্ধ : নির্বাচিত গল্প। প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণ : মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও ব্যর্থতা, মুক্তিযুদ্ধ : ডেটলাইন আগরতলা, জনযুদ্ধের উপাখ্যান, গণহত্যা প্রতিরোধ স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ, যুদ্ধাপারাধীদের বিচার ও প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পালাবদলের ইতিহাস নাটক : অগ্রাহ্য দণ্ডোৎসব, পোস্টার ৭১।