১৩১ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী খুলনা জিলা স্কুল। ভৈরব নদের পাড়ে গাছপালায় ঢাকা এক নির্জন পরিবেশে ১৮৮৫ সালে এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে কারো মতে এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ সালে। তখন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘খুলনা হাই স্কুল’। সে হিসেবে এটি খুলনা শহরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম স্কুল। আবার কারো মতে এ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৩ সালে। সে হিসেবে খুলনা জিলা স্কুল শহরের প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় স্কুল। ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠটি ৯ একর ৩৩ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্কুলের সামনে রয়েছে সুপ্রশস্ত একটি খেলার মাঠ। ২০০৫ সালে প্রাক্তন ছাত্ররা সাড়ম্বরে স্কুলের ১২০ বছর পূর্তি উত্সব পালন করেন।
বর্তমান রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়ার বাসিন্দা দারোগা বাবু সীতারাম মজুমদার তার নিজ অর্থ দিয়ে স্কুলের প্রথম পাকা ভবন তৈরি করেন।
১৮৮৩ সালের হান্টার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে তত্কালীন ইংরেজ সরকার এ বিদ্যাপীঠের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। তখন থেকে ‘খুলনা জিলা স্কুল’ নামে এ বিদ্যালয়ের নতুন পরিচয় হয়। সুদৃশ্য লাল ভবনটি সগর্বে এখনো ওই সময়ের স্মৃতি বহন করছে। এটিই খুলনা জিলা স্কুলের মূল ভবন। মূল কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রেখে ভবনটিকে ১৯৯৫ সালে সংস্কার করা হয়। এ বিদ্যালয়টিতে এককালে আরবি, ফারসী, ও উর্দু ভাষা চালু ছিল। ১৯৬৩ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার টেকনিক্যাল শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের মাঠের উত্তর পাশে তিনতলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করে। যা বর্তমানে প্রশাসনিক ভবন নামে পরিচিত। এক পর্যায়ে নির্মাণ করা হয় হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা দুটি ছাত্রাবাস।
খুলনা জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু জারুকুনাথ সিরকার। তিনি ১৮৮৫ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত মাস প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া প্রথম দিকের আরও ৫ জন প্রধান শিক্ষক হলেন, রাখাল দাস চক্রবর্ত্তী, নবিনী মোহন স্যান্যাল, বাবু সারদাচরণ মিত্র, কেদারনাথ গাঙ্গুলী ও প্রিয়নাথ রায়। এ স্কুলের প্রথম মুসলমান প্রধান শিক্ষক হলেন খান সাহেব মৌলানা সিরাজউদ্দীন আহমেদ। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি ১৯৩২ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ১৯৩৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ তিন বছর সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজল খুলনা জিলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এ স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
এ স্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, কবি ফররুখ আহমদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, সাবেক পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী খান-এ-সবুর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান, বিচারপতি মকসুমুল হাকিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি উপদেষ্টা এস. এ. করিম, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, কথা শিল্পী আনিস সিদ্দিকী, প্রখ্যাত অভিনেতা নাদিম, গোলাম মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, পাকিস্তানের সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান আসলাম বেগ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মেজর গনি, নায়ক উজ্জ্বল, নাজমুল হুদা, প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ, জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রয়াত খেলোয়াড় মানজারুল ইসলাম রানা, বর্তমান সরকারের সচিব আশরাফুল মকবুল, ওয়াহিদুজ্জামান, জাতীয় দলের ক্রিকেটার নূরুল হাসান সোহান, ক্ষুদে গান রাজ রাতুল প্রমুখ।
এ স্কুলের সুনাম দেশব্যাপী। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে যশোর বোর্ডে পর পর সাতবার প্রথম স্থান অধিকার করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিগত তিন বছরের মধ্যে ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় শতকরা ৯৯.৩০ ভাগ, ২০১৫ সালে ৯৯.০৭ ভাগ ও সর্বশেষ ২০১৬ সালে ৯৯.২৬ ভাগ ছাত্র পাস করেছে। জেএসসি পরীক্ষাতেও বিগত তিন বছরে পাসের হার প্রায় শতভাগ। বর্তমানে এ স্কুলে দু’ শিফটে ছাত্রদের পাঠদান দেয়া হয়। দু’ শিফটে ছাত্রসংখ্যা ৩ হাজার ৭১ জন। এ স্কুলে শিক্ষকের পদ রয়েছে ৩৫টি।
ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠের লাইব্রেরি অনেক পুরানো। গ্রন্থ সংখ্যা ৮ হাজার। এখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ্যও আছে। ব্রিটিশ যুগে মুদ্রিত ও প্রকাশিত অনেক বই এখানে রয়েছে।
পড়ালেখা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে এ স্কুলের সুনাম কম নয়। ক্রিকেট ও বাস্কেট বলে এ বিদ্যালয় পরপর কয়েকবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এছাড়াও স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সঙ্গীতে পারদর্শিতার ছাপ রেখে চলেছে এ স্কুলের ছাত্ররা।
বিদ্যালয়ে ৯টি ভবন রয়েছে। যেখানে শ্রেণি পঠন-পাঠনের কাজ হয়ে থাকে। বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে ২টি একতলা ছাত্র হোস্টেল আছে। যেখানে বর্তমানে শিক্ষক ও কর্মচারীরা থাকেন। এছাড়া এ বিদ্যালয়ে রয়েছে একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি শিক্ষকদের কমন রুম, ৬টি ল্যাবরেটরি, একটি খেলার মাঠ, একটি অডিটোরিয়াম, একটি মসজিদ ও একটি শহীদ মিনার।
খুলনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই যশোর বোর্ডসহ সারাদেশের মধ্যে ভাল রেজাল্ট করে আসছে। তবে স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক। ফলে সীমিত সংখ্যক শিক্ষকের পক্ষে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়া রয়েছে শ্রেণিকক্ষ ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের সংকট। আর ভবনগুলোও অনেক পুরাতন হয়ে গেছে, এগুলো জরুরিভাবে সংস্কার করা দরকার।