‘বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তার আপন মহিমা ও কর্মসুষমা নিয়ে’_ এ কথা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই। খোদ বিদেশি অতিথি, বিশ্বব্যাংক প্রধান ও পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রনায়করাই বাংলাদেশের গুণকীর্তন করছেন। কেউ কেউ এ কথাও বলছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে এশিয়ার বাঘ। বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও খাদ্য উদ্বৃত্ত রাখার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে শেখ হাসিনা সরকার। দেশের দরিদ্রজনগোষ্ঠীর অভাব হাহাকার আর চোখে পড়ে না। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। শান্তি সূচকেও প্রতিবেশী দেশ থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ ছাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে দেশ।
দেখতে দেখতে মহান স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার করলাম আমরা। ইতিমধ্যে আমরা মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৩ বছর পার করেছি। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাও আমরা রক্ষা করে চলেছি। আমাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতার কমতি নেই; কিন্তু আজও আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি পুরোপুরি আসেনি। সামাজিক-রাজনৈতিক, শিক্ষা, মানবাধিকার ও আইনের শাসনজনিক গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিও ততটা সুখকর নয়। চার দশকে আমাদের যতটা এগোনোর কথা ছিল ততটা এগোতে পারিনি। আবার আমরা একেবারে যে পিছিয়ে আছি তাও নয়।
শান্তির নিরিখে ভারতের থেকে অনেকটাই এগিয়ে বাংলাদেশ। এ ছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলংকা, মিয়ানমার কিংবা ভুটানেও ভারতের চেয়ে অনেক বেশি শান্তি বিরাজ করছে বলে জানিয়েছে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলেছিল, বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে যেখানে দুই কোটি ৮০ লাখ অর্থাৎ ১৮ শতাংশ হতদরিদ্র মানুষ ছিল, সেখানে সাত বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ হতদরিদ্র অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। এ ছাড়া একাধিক পরিসংখ্যানেও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ আর ২০১৬ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে। বিশ্বব্যাংক ধারাবাহিকভাবে অতিদারিদ্র্যের হার কমার এই প্রবণতাকে ‘অর্জন’ হিসেবে মনে করে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরাও আশা করেছেন, দারিদ্র্যজয়ের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০৩০ সালে দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূন্য থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কর্মকা- সে লক্ষ্যেরই ইঙ্গিতবাহী। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছবেই।
কৃষি এ দেশের অর্থনীতির মেরুদ-। নারীর মাধ্যমেই কৃষি সভ্যতা সূচিত হয়েছে। গ্রামীণ নারী সমাজই হচ্ছে স্থানীয় কৃষি ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র, যার মূল জোগানই আসে কৃষি খাত থেকে। ফলে দেশের কৃষি খাতেও লেগেছে উন্নতির ছোঁয়া। ধানের পাশাপাশি বেড়েছে মাছ, মাংস ও সবজির উৎপাদন। আর কৃষির এই উন্নয়নে যে গ্রামীণ নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে, তা সর্বজনবিদিত। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও ভেষজ ওষুধ ব্যবহারে নারীই প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। গড় হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর অবদান বেশি। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না । এখন বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন আর অপার সম্ভাবনা নিয়ে বাঁচতে চায়। স্বপ্নবিলাসী বাঙালি কঠিন জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে নানা ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে। পায়ে পায়ে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। এত বছর পরও স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো কতটুকু প্রতিফলিত করতে পেরেছি, তা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগে। আমরা আসলে কী চেয়েছিলাম আর কী পেয়েছি? আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। আমরা চেয়েছিলাম অর্থনৈতিক মুক্তি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা কি তা পুরোপুরি পেয়েছি? আমাদের স্বপ্ন ছিল, এ দেশের মানুষ যাতে না খেয়ে কষ্ট না পায়, আমাদের দেশের মানুষ যাতে অশিক্ষিত না থাকে, তার ব্যবস্থা করা। আমরা তা এখনও পুরোপুরি পারিনি। তবে দেশে অতি দরিদ্রের হার কমে এসেছে। এটা আশার কথা। এই কমে আসার কারণ হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য বলেছেন ‘কয়েক বছর ধরে সরকারের নেয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য। আমরা চাই, এই হার আরও কমাতে সরকার পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে এবং এর ফলে যেন আগামী দিনেও সফলতা ধারা বজায় থাকে।’
আমাদের অর্জন আর বিসর্জনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আত্মমূল্যায়ন করতে হবে। বিবেককে জাগ্রত করে আত্মশুদ্ধির দিকেও যেতে হবে। ‘বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিবিষয়ক কৌশলগত পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ এখনও ক্ষুধার্ত থাকে। এখনও দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের ক্ষুধার্ত থাকার বিষয়টি সামগ্রিক অর্থেই নেতিবাচক। এই দিকেও সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কারণ এটা পুরোপুরি দারিদ্র্য হ্রাসের নজির নয়।
আমরা বারবার আক্ষেপ করে বলতাম, মালয়েশিয়া ঘুরে দাঁড়াল, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম ২৫ বছর যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালো, জাপান আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়াল, আমরা পারছি না কেন? এই আক্ষেপ এখন তিরোহিত হতে শুরু করেছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিস্ময়কর। পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকেও ঈর্ষার চোখে দেখছে অনেকেই। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ও স্বপ্ন নিয়ে ৪৫ বছর আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। অনেক নেতিবাচক ও অন্ধকার দিককে পায়ে ঠেলে, মাড়িয়ে-ডিঙিয়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেক সংকট আর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই, স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনে অনেক বেগ পেতে হয়। স্বাধীনতার পর পরই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে দেশ। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু হয় একটি স্বাধীন দেশের। এ সময় বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে তিরস্কার করেছিল বিশ্বের অনেক দেশই। যুক্তরাষ্ট্র সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে বলেছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। আর এখন স্বাধীনতার ৪৫ বছরে বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নেই। আগামীতে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হবে সরকারকে। ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে পূর্বেকার কাজের ও নানা ধরনের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের। সরকারের যেসব কর্মকা-ে গণঅসন্তোষ তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে ওইসব কাজ থেকে বিরত থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অগ্রসর হতে হবে। যে কোনো কল্যাণরাষ্ট্রের শাসকদের কর্তব্যও তাই। গণতন্ত্রের জয়ধ্বনি করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ অচিরেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এই আশাবাদ দেশের সচেতন মানুষের। আমাদের ২০৪১ সালের মধ্যে দাঁড়াতে হবে উন্নত দেশের কাতারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, একাগ্রতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সফল বাস্তবায়নের মধ্যদিয়েই আমাদের দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে শামিল হয়েছে। বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের মহাসড়কে হাঁটছে। যার অন্যতম শর্ত হচ্ছে দারিদ্র্যবিমোচন। তবে সার্বিকভাবেই বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন বিশ্ববাসীর চোখে পড়ার মতো। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে শিক্ষা ও সচেতনতার হার। অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার, গ্রামীণ এলাকায় সড়ক ও জনপথের ব্যাপক উন্নয়ন এবং সংযুক্তি, গ্রামীণ অকৃষি কর্মসংস্থান, প্রবাসী আয় অব্যাহতভাবে বাড়া ও ব্যাপক বিদ্যুতায়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণেই দেশে দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্য এসেছে। এসব উন্নয়নমুখী কর্মকা-ে শক্তিশালী হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দিনে দিনে মানুষ এখন আত্মনির্ভশীল হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম অবকাঠামো ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে দেশ। বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। তারা এখন অনায়াসে বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, সৃষ্টিশীলতা ও আন্তরিকতার কারণে। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা পেরেছি আমরাই পারব। উন্নত জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রা আর কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। যেমন পারেনি একাত্তরে।
সালাম সালেহ উদদীন : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক