আহসান হাবিব খোকন। কৃষক পিতার দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয়া এক স্বপ্নবাজ তরুণের নাম। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের পিতলগঞ্জ গ্রামের মৃত কৃষক আবদুল আজিজ মিয়ার ৫ সন্তানের মাঝে সবার ছোট খোকন। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল কৃষি কর্মকর্তা হবে। কৃষকদের উন্নতর প্রশিক্ষণ দিয়ে খাদ্যে দেশ স্বনির্ভরে ভূমিকা পালন করবে সে। কিন্তু প্রবাদের মতোই ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্নের মতোই অধরা থেকে যায়। টেনেটুনে এসএসসি পাস করার পর অন্য ভাইদের মতো সংসারের হাল ধরা প্রয়োজন হয়ে উঠে খোকনের। রাজধানীর একটি ছাপাখানার কর্মচারী থেকে কঠোর পরিশ্রম করে একদিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হন তিনি। ৫ বছর আগে এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছির চাষাবাদ দেখে এ পেশায় আগ্রহী হন খোকন। তারপর নিজেই শুরু করেন মধুচাষ। মধুচাষে মধুময় সুখী জীবনের খোঁজ পান খোকন। আসতে থাকে সফলতা। ছোট থেকে বড় পরিসরে চলে ব্যবসা। সঙ্গে খুঁজে পান তার চিরদিনের পুঞ্জীভূত স্বপ্নের সন্ধান। খোকন এখন মৌমাছি চাষাবাদের প্রশিক্ষক। এখন তিনি কৃষি কর্মকর্তাসহ শত শত বেকার যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে মধুচাষে আগ্রহী করে তুলছেন।
শুরুর গল্প
২০১১ সালে হঠাৎ গাজীপুরের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে যান তিনি। সেখানে একটি বাড়িতে মৌমাছি চাষ দেখে নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠেন। এজন্য গাজীপুরের ভাদুন এলাকায় বিসিকের বিভাগীয় কেন্দ্র থেকে মৌমাছির চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে মৌমাছি পালনের জন্য ৫টি বক্স কিনে এনে নিজ বাড়ি পিতলগঞ্জে প্রথম শুরু করেন মৌমাছির চাষ। প্রেসের ব্যবসার পাশাপাশি মৌমাছির পরিচর্যা শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই দেখতে পান লাভের মুখ। তাই তিনি আস্তে আস্তে আরো বক্স তৈরি করে বাণিজ্যিক আকারে মৌমাছি চাষ করার জন্য কাজ শুরু করেন। বাড়ির আশপাশের লোকজন তারা তাদের সবজি চাষাবাদের ক্ষেত্রে ফলন ভালো পাওয়ার আশায় জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে। যার দরুন মৌমাছি চাষে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এ জন্য খোকন তার এক আত্মীয়ের বাড়ি একই উপজেলার ভোলাব ইউনিয়নের গুতুলিয়া এলাকার ফজর আলী নামে এক বৃদ্ধের একখণ্ড পতিত উঁচু ভূমিতে এ মৌমাছি চাষ শুরু করে। বর্তমানে তার প্রায় ১৫০টির মতো মৌমাছি পালনের বক্স রয়েছে। প্রতিটি বক্সের ভেতর ৭-৮টি ফ্রেম রয়েছে। তার এ মৌমাছি পালতে প্রশান্ত কুমার মণ্ডল ও রমজান নামে দু’জন কর্মচারী রয়েছে। যারা সর্বদাই এগুলোর দেখাশোনা করেন।
উৎপাদন
মৌমাছি বসবাসের প্রতিটি বক্সের ভেতরে ৭ থেকে ৮টি ফ্রেম থাকে। আর সেই ফ্রেমের মধ্যে মৌমাছিগুলো বসবাস করে। প্রতি বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মৌমাছি থেকে প্রচুর পরিমাণে মধু আহরণ করা যায়। সর্বশেষ জুন মাস পর্যন্ত মধু আহরণ করা যায়। বাকি মাসগুলো মৌমাছিদের খাবার দিয়ে রাখতে হয়। সরজমিনে ঘুরে জানা যায়, প্রতি বছর সরিষা, ধনিয়া, কালিজিরা ও লিচু ফলনের মৌসুমে মৌমাছি থেকে অনেক মধু পাওয়া যায়। এর মৌসুমের সময় মাত্র ৪ মাস। এ ৪ মাসে গড়ে প্রতি বক্স থেকে ৫০ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। এ জন্য মৌসুমে খোকন তার মৌমাছির বক্সগুলো ট্রাকে করে ধনিয়া কালিজিরার মৌসুমে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এলাকায়, লিচুর মৌসুমে সোনারগাঁও, গাজীপুর, পাবনা, নওগাঁ ও দিনাজপুর এলাকায় আর সরিষার মৌসুমে ঢাকার ধামরাই, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। প্রতি মাসে মৌমাছি পালনের বক্স থেকে ২ থেকে ৩ বার মধু সংগ্রহ করা যায়। আর প্রতিবার কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ কেজি মধু পাওয়া যায়। গত বছর এ মৌসুমে প্রায় ৩২০০ কেজি মধু সংগ্রহ করেছেন বলে তিনি জানান।
বাজার
খোকন তার পালন করা মৌমাছি থেকে আহরণ করা মধু উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাজার পেরিয়ে দেশের নামিদামি কোম্পানি এপি মধু, ঢাকা ৭৮৬ হানি, উত্তরা ওয়াও মধু, নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার আহমেদ ফার্ম হাউজসহ কয়েকটি কোম্পানি ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন বিপণি বিতানে তিনি মধু বিক্রি করে থাকেন। যখনই মধু সংগ্রহ করা হয়। তখনই সেই কোম্পানির নিয়োজিত লোকজন এসে মধু কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি মধু পাইকারিভাবে বিক্রি করা হয় ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। সব মিলিয়ে গড়ে তিনি মৌমাছি থেকে আহরণ করা মধু বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হয় বলে খোকন জানান।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে খোকনের পরিবারে কোনো অভাব-অনটন নেই। তিনি পরিবার পরিজনদের নিয়ে বেশ ভালোই আছেন। ২০১১ সালে গাজীপুরের ভাদুন এলাকার বিসিকের বিভাগীয় সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া আহসান হাবিব খোকনকে উপজেলার সর্বত্রই এক নামে চিনে। এ উপজেলায় বিসিকের মাধ্যমে মৌমাছির উপর যে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে সব কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে রত আছেন খোকন। সরেজমিনে গত সোমবার গুতলিয়া এলাকায় তার মৌমাছি পালন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় সেখানে রূপগঞ্জ উপজেলা থেকে উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মহসীন মিয়া, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল বাতেন, ইলিয়াছ মিয়া, আলতাফ হোসেন, অসীম কুমার তালুকদার, উত্তম কুমার দাস, জহিরউদ্দিন বাবর, স্থানীয় কৃষক আমিনুল ইসলাম মোল্লা, রফিকুল ইসলাম, প্রশান্ত কুমার মণ্ডল নামে মোট ১৫ জন তার কাছে মৌমাছি পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এমনকি উপজেলায় কোথাও যদি মৌমাছির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেটা এই খোকনই দিয়ে থাকেন। এদিকে, তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে উপজেলার পিতলগঞ্জ এলাকার জয়নুল মুনাইম, মোহসীন মোল্লা, জহিরুল ইসলাম মোল্লা, রতন মিয়া, নাসরিন আক্তার, স্মৃতি আক্তার, সখিনা বেগমসহ আশপাশের গ্রামের প্রায় ২০ জন এ মৌমাছির চাষ করছেন।
মৌমাছি চাষের প্রশিক্ষণ নিতে আসা উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, মধু একটি উপাদেয় খাদ্য। মৌমাছি সেবক এলাকায় বেশি থাকে সেসব এলাকায় সরিষা, লিচু, কালিজিরা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন ফলমূল ও সবজির উৎপাদন অন্যসব এলাকা থেকে ১৫ থেকে ২০ ভাগ বেশি হয়। মৌমাছির কারণে অন্যসব ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তাই আমরা বিসিকের মাধ্যমে আহসান হাবিব খোকনের কাছে ১৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর সাধারণ কৃষকদের আমরা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে মৌমাছি চাষের ক্ষেত্রে উৎসাহী করে তুলবো। এমনকি নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে মৌমাছির চাষ করবো।
এ ব্যাপারে আহসান হাবিব খোকন জানান, একসময় অনেক কষ্টে আমাদের সংসার চলতো। টাকার অভাবে বেশি লেখাপড়াও করতে পারিনি। বেকারত্ব যে কি অভিশাপ সেটা আমি উপলব্ধি করেছে। বর্তমানে মা, ভাইবোন, সন্তানদের নিয়ে অনেক সুখে আছি। আজ আমার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আশপাশের এলাকার অনেক মানুষ এ মৌমাছি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তিনি আরো বলেন, মৌমাছি পালনে তেমন পরিশ্রম করতে হয় না। কাজে টাকা লাগে কম কিন্তু আয় হয় বেশ ভালো। এজন্য আমার মতে যারা বেকার যুবক-যুবতী, গৃহিণী রয়েছেন তারা এ প্রশিক্ষণ নিয়ে অর্থের অভাব অনেকটা লাগব করতে পারবেন এমনকি মধু রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সরকার যদি মৌমাছি চাষের জন্য আমাদের দেশের বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎসাহী করে তাহলে দেশের বেকার সমস্যা অনেকটাই দূর হবে বলে তিনি আরো জানান।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুরাদুল হাসান বলেন, মৌমাছির চাষ ও সেখান থেকে মধু আহরণ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ এবং বাকি মধু বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তাই আমার অধীনে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বিসিকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আর সেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এ উপজেলারই যুবক আহসান হাবিব খোকন। শুনেছি তার কাছ থেকে আশপাশের এলাকার বহু ব্যক্তি প্রশিক্ষণ নিয়ে এ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।