গৌরবের পথচলা

মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা ও বিজয়ের স্মারক হিসেবে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী’ সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক (ঈড়হাবহঃরড়হধষ) আক্রমণের সূচনা করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন_ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন_ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’। তিনি নির্দেশ দেন_ ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতির এই জাগরণে ভীত ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে শুরু করে অত্যাচার, নির্যাতন, খুন।

১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমপিকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমপিকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ এমপিকে প্রধানমন্ত্রী করে মেহেরপুরের মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশের প্রথম সরকার’ গঠিত হয়। সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ ছাত্র, শ্রমিক, জনতা তথা বীর বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সর্বাধিক কার্যকরী এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক নেতৃত্বের প্রয়োজন বোধ করে সরকার এবং এ লক্ষ্যে কার্যকর অবকাঠামো গঠনের নিমিত্তে কর্নেল এমএজি ওসমানীকে (পরবর্তীকালে জেনারেল) কেবিনেট মিনিস্টার মর্যাদাসহ বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়াও কর্নেল (অব.) এমএ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়।

রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই সমগ্র বাংলাদেশকে ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে একেকজন জ্যেষ্ঠ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয় সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রভৃতি কাজ কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করতে থাকে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত অংশকে বলা হতো গণবাহিনী, যা সাধারণ জনগণ থেকে বাছাইকৃত লোকবল নিয়ে গঠিত হয়েছিল। নিয়মিত যুদ্ধের জন্য সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি বাহিনীর লোকবল নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী এবং তিনটি ব্রিগেডও গঠন করা হয়েছিল। ১. জেড ফোর্স, ২. এস ফোর্সর্, ৩. কে ফোর্স। ‘জেড ফোর্সে’র অধিনায়ক নিয়োগ দেওয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে যা ১ম, ৩য় এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয়। ‘এস ফোর্সে’র অধিনায়ক নিয়োগ দেওয়া হয় মেজর কেএম সফিউল্লাহকে, যা ২য় এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয়েছিল। মেজর খালেদ মোশাররফকে ‘কে ফোর্সের’ অধিনায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়, যা গঠিত হয়েছিল ৪র্থ, ৯ম এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে। বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে এই ১১টি সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেডের মাধ্যমে ৪ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাপকভাবে সমগ্র দেশে কার্যকরভাবে পাকিস্তানি দখলদারের বিরুদ্ধে অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অকেজো এবং বিমানবাহিনী বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা হামলা করে। আমাদের নৌ ও বিমানবাহিনীও মুক্তিযুদ্ধে সাহসী এবং কার্যকর অবদান রাখে।

১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং আপামর জনসাধারণ একযোগে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত অভিযানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়।

বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে অধিকাংশ সময়ই মিত্রবাহিনী অধিকৃত অঞ্চল/দেশ থেকে ফেরত আসে না। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আজও আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী জার্মানি এবং জাপান থেকে, ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনী জার্মানি থেকে ফেরত আসেনি বরং কৌশলগত কারণে আজও সে দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্রবাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে ১৭ মার্চ, ১৯৭২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যায়, যা ইতিহাসে বিরল। রাশিয়ান বাহিনী যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর চালু করতে এসেছিল, তারাও যথাযথভাবে কার্য পালন শেষে ফিরে যায়।

শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্ত্র প্রহরী। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিশ্বের সব দেশের শীর্ষস্থানে রয়েছে; যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী শান্তিরক্ষার পাশাপাশি ওইসব দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। গত ২৩ জুলাই, ২০১৫ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন গঙঘটঝঈঙ (কঙ্গো) পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত (ঝজঝএ) এবং ফোর্স কমান্ডার লে. জেনারেল কার্লোস আলবার্টো মনিটোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তারা উভয়েই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কঙ্গো মিশনে অবদান, অর্জন ও কার্যকর ভূমিকার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অবদান দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে এবং বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে।

১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইমারজেন্সি অভিযানে জড়িয়ে পড়ে শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়ছিল। বিচ্ছিন্ন এ যুদ্ধে অফিসারসহ বিভিন্ন পদবির অনেক সৈনিককে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও শান্তি বাহিনীর সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অপেক্ষাকৃত শান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন অব্যাহত রাখতে সেনাসদস্যদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে।

জাতীয় উন্নয়নে সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। সশস্ত্র বাহিনী এমনই এক বাহিনী যার প্রতি এ দেশের জনগণের রয়েছে অগাধ আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা ছাড়াও দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ছিন্নমূল মানুষের জন্য বাসস্থান তৈরি করা এবং অন্যান্য জনকল্যাণমুখী কাজে প্রতিনিয়ত সশস্ত্র বাহিনী নিবেদিতপ্রাণ। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডঅ্যাবল পাসপোর্টসহ জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস নির্মাণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা গৌরবজনক।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অতীতে আমাদের প্রিয় সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্য ভুলক্রমে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান অর্থাৎ হত্যা, ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের এবং সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষতিসাধন করেছে। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এসব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ এবং সশস্ত্র বাহিনীর ওইসব সদস্য, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল অথবা জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশ এবং সশস্ত্র বাহিনীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা জানি, একজন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যকে প্রশিক্ষণসহ পেশাগতভাবে উপযুক্ত করতে দেশের অনেক সম্পদের প্রয়োজন হয়। দেশের কেউ চায় না দেশ ও জাতির এ মহান সম্পদ অকালে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিনষ্ট হোক।

আশা করব গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল থেকে পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে তৎপর থাকবে। জাতির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই হবে তাদের অঙ্গীকার। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জাতির প্রয়োজনে সর্বদা অবদান রাখবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য