‘ভেঙে গেছে আজ সেই মধুর মিলনমেলা/ভেঙে গেছে আজ সেই হাসি আর রঙ্গের খেলা’_ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের মতো ভেঙে গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন-প্রবীণের মিলনমেলা। সুবর্ণজয়ন্তীতে বয়সের ব্যবধান ভুলে মেতেছিলেন তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায়। পুরনো বন্ধুদের নিয়ে গেয়েছিলেন গান। ফিরে গিয়েছিলেন সোনালি সেই অতীতে। পাহাড়ের ভাঁজে রাত জেগে আড্ডা। ছিল সোনা ঝরা দিনগুলো ফিরে পাওয়ার আকুতি। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের উষ্ণতায় সিক্ত পাহাড়ি কন্যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সুবর্ণজয়ন্তীর দু’দিনের উৎসবের শুরু শুক্রবার বিকেলে। নগরের বাদশা মিয়া সড়কের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। বেলুন উড়িয়ে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। র্যালিতে অংশ নেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, সাবেক চিফ হুইপ ও সাংসদ উপাধ্যক্ষ আবদুশ শহীদসহ বর্তমান ও প্রাক্তন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। শোভাযাত্রাকে রঙিন করে তোলে ডাইনোসোর, বিশাল আকৃতির ফড়িং ও ষাঁড়ের প্রতিকৃতি। জীবন্ত হাতি ও ঘোড়ার গাড়িতে চড়েও শোভাযাত্রায় অংশ নেন প্রাক্তনরা। অংশগ্রহণকারীদের হাতে প্ল্যাকার্ড, মাথায় ব্যান্ড, শরীরে নানা রঙের টি-শার্ট। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে উৎসবের নগরীতের পরিণত হয় চট্টগ্রাম। শোভাযাত্রা শেষ হয় সিআরবির শিরীষতলায়। গোধূলির মরে যাওয়া রোদে সবাই মিলিত হন শিরীষতলায়। বন্ধুর মুখোমুখি বসে মেলে ধরেন গল্পের ঢালি। খুনসুটি। বয়স ভুলে মেতে উঠেন হাস্যরসে।
রাতে প্রাক্তনরা জড়ো হন জিইসি কনভেনশন সেন্টারে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের স্বাদ নেন। সেখানে চুটিয়ে আড্ডা দেন তারা। স্মৃতি রোমন্থন। নেচে-গেয়ে মাতিয়ে তোলেন উৎসবকে। সঙ্গে ছিল সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লার গান। এ ছাড়াও সঙ্গীত পরিবেশন করেন ‘সোনাবন্ধু ও মধু হই হই’ গান খ্যাত সন্দীপন ও হৈমন্তী রক্ষিত মান। মধ্যরাতের পর ভাঙে প্রথম দিনের মিলনমেলা।
১৯ নভেম্বরের সকাল। শনিবার। বয়সের জীর্ণতা ভুলে ছুটেছেন সবাই স্মৃতির ক্যাম্পাসে। কেউ শাটলে, কেউ আবার বাসে। শাটলের শরীর হয়ে উঠে তবলা। সবাই গায়ক। উদাস কণ্ঠে গেয়ে উঠেন_ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো যায় যায়/ হারিয়ে যায়/ উজ্জ্বল, বর্ণালি দিনগুলো হায়/ মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।’ ফিরে যাওয়া পুরনো দিনে। জড়ো হন কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। সেখানে দুপুর পর্যন্ত চলে আলোচনা সভা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানানো হবে। এরপর মঞ্চ মাতায় ওয়ারফেজ, লালন ও আর্টসেল।
দুপুরের পর স্মৃতির আকর খুঁজে নিতে প্রাক্তনরা ছড়িয়ে পড়েন ক্যাম্পাসের নানা প্রান্তে। কেউ কেউ ঝুপড়িতে মেতে উঠেন আড্ডায়। হারিয়ে যান জারুলতলায়। কেউ কেউ ছুটে যান শামসুন্নাহার ও প্রীতিলতা হলেও। কেউ আবার এফ রহমান-আলাওলে। প্রতীক্ষার প্রহর গোনা বেঞ্চিগুলো ছুঁয়ে দেখেন আলতো করে। দাঁড়ান চিরচেনা গাছটির নিচে। হলের অপেক্ষালয়টিতে বসেন ক্ষণিকের জন্য। বুকের কোণে জমে উঠে মেঘ। উছলে পড়ে চোখের কোণে। ছুটে বেরিয়ে আসেন। স্মৃতির ঝড়ো হাওয়া থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচেন।
প্রাক্তনদের উচ্ছ্বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামি গার্ডেন, কলা অনুষদের ঝুপড়ি, জারুলতলা, শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বর, গোলচত্বর, স্টেশন চত্বর ও শহীদ মিনার হয়ে উঠে প্রাণবন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। বার্ধক্যকে পায়ে দলে ছুটে এসেছেন প্রাণের আঙিনায়। যেখানে কেটেছে তারুণ্যের সোনাঝরা দিনগুলো। বললেন, ‘এমন আয়োজনের জন্য দীর্ঘদিন প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমাদের ব্যাচের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে এ নিয়ে আলোচনার পর বিশ্ববিদ্যালয়কে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ উৎসব আয়োজনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কষ্ট না করলে এমন মধুর মিলনমেলা তো চোখে দেখে যেতে পারতাম না। বন্ধুদের সঙ্গেও হয়তো আর দেখা হতো না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২৭তম ব্যাচের ফারজানা আকতার। তিনি বলেন, ‘১৮ বছর পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই ভালো লাগার কোনো ভাষা নেই। এমন আয়োজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ।’ দু’দিনের উৎসবের পর বিচ্ছেদের বিষাদ নিয়ে যেন নামে শনিবারের সন্ধ্যা। চিরচেনা ক্যাম্পাসকে পেছনে ফেলে, বন্ধুর জলে ভরা চোখ ফাঁকি দিয়ে ফিরে যাওয়ার পালা। পেছনে যেন বেজে উঠে_ যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…।