সম্প্রতি বাংলাদেশে সফর করে গেলেন গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ঢাকা থেকে তিনি ভারতের গোয়ায় যান বিমসটেকের এক সম্মেলনে যোগদানের জন্য। এর পরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিমসটেকে যোগদানের জন্য ভারত সফরে যান এবং সেখানে বক্তৃতাও দিয়েছেন। বাংলাদেশ সফরে গণচীনের সঙ্গে আমাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। অনেক চুক্তির বিষয়ে কথাও হয়েছে। সম্প্রতি জাপান আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করেছে। তারা অনেক দিন ধরেই আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে। অর্থাত্ সাম্প্রতিক অবস্থা পর্যালোচনায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম সম্প্রতি বাংলাদেশ ভ্রমণ করে গেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের। ১ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়া হবে শিশুদের পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণে এবং বাকি ২ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়। চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রদানের।
বাংলাদেশকে এখন অনেকেই মনে করছেন একটি সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল দেশ। শুধু মাথাপিছু আয় ছাড়া বাকি সব পরিমাপকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। দেশের বিনিয়োগকারীরা উন্নত প্রযুক্তি, বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিজেদের যেভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট পল রোমার বলেছেন, বাংলাদেশ যে গতিতে উন্নতি করছে, সেটা ভালো যদি তারা এটি ধরে রাখতে পারে। আর না পারলে অনেক পিছিয়ে পড়বে দেশ। এক ঐতিহাসিক সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হবে দেশের জনগণ।
উত্তরবঙ্গ এমনকি ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত পণ্য পৌঁছানোর জন্য অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ উভয়ই যেন কম লাগে, তা নিশ্চিতেও নেয়া হয়েছে উদ্যোগ। বন্দর উন্নয়নে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং থেকে এর ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে কাজ চলছে। বন্দরের চ্যানেলে ড্রেজিং করা হচ্ছে। সম্প্রতি পায়রা বন্দর গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। পায়রা বন্দরের গভীরতা যথেষ্ট না হওয়ায় ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আমাদের জন্য পায়রা বন্দর হবে নতুন সম্ভাবনার জায়গা। এর আগে আমরা মংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু তা খুব বেশি আশা জাগাতে পারেনি। মংলার পোতাশ্রয়ের গভীরতা অনেক কম, তাই সেখানে বড় জাহাজ আসতে পারে না।
বিদ্যুত্ খাতে আমাদের অগ্রগতি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ খাতে আমাদের বিনিয়োগ অনেক বেশি। তবে বিদ্যুত্ খাত এখনো ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। আমরা বড় ব্যয়সাশ্রয়ী ও নিজস্ব বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের দিকে এখনো যেতে পারিনি। এখন প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উৎপাদন করছি। অল্প সময়ের মধ্যেই তা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। বিদ্যুতে অগ্রগতি হলেও আমরা গ্যাসের দিক থেকে পিছিয়ে আছি। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার থেকে শুরু করে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন ও সঞ্চালন লাইন আরো আধুনিক করতে হবে। আমরা এলএনজি গ্যাস টার্মিনাল করছি। সেক্ষেত্রে আমাদের সঞ্চালন লাইন তৈরি করে জাতীয় গ্রিডে তা যুক্ত করতে হবে। এতে আমাদের গ্যাস সমস্যার সমাধান হবে অনেকাংশে। দেশে এলপিজিরও ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। মাতারবাড়ী নিয়ে একটা সম্ভাবনা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম কিন্তু গুলশান হামলার পর এ প্রকল্প কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে।
আমাদের আগে এলএনজি নীতি তৈরি করতে হবে। সরকার এলএনজিনির্ভর পাওয়ার প্লান্ট তৈরির অনুমতি দিলেও নীতির অভাবে তা এগোচ্ছে না। বিনিয়োগকারীরা নীতির ওপরই গুরুত্ব দেন বেশি। অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, সরকার পরম্পরায় প্রকল্প চালিয়ে নেয়ার অনীহা কাজ করে। এক সরকার আরেক সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায় না। আমরা এ অবস্থার পরিবর্তন চাই।
রামপুরা থেকে ভুলতা পর্যন্ত একটি ট্রেড করিডোর তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়ার আলোচনা শুরু হয়েছে। এটা হলে রামপুরা থেকে ভুলতা হয়ে কাঁচপুরে পণ্যবাহী ট্রাক ১৫ মিনিটেই পৌঁছে যাবে। এ প্রকল্প পিপিপির আওতায় সম্পন্ন করা হবে বলে জানা গেছে। পিপিপির আওতায় অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এর সাফল্য দৃশ্যমান হচ্ছে এখন। ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে পিপিপির আওতায়। ১০০টি ইকোনমিক জোন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর কিছু নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে করার পরিকল্পনা রয়েছে। খুলনা-যশোর অঞ্চলকেও নির্বাচন করা হয়েছে অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য। সেখানে আমরা মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারব। আমরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরকে শিল্পঘন অঞ্চল হিসেবে দেখতে চাইছি না। আমরা শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে চাইছি দেশব্যাপী।
দারিদ্র্য বিমোচনে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছি। মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ এখন চরম দরিদ্র। এটা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লেখ আছে এবং এ সংখ্যাকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। নিবন্ধের শুরুতে বলেছি, আমরা মাথাপিছু আয় ছাড়া প্রায় সর্বক্ষেত্রে এগিয়েছি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি দুর্দশায় পড়লেও আমাদের ওপর তার প্রভাব পড়বে না। এরই মধ্যে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। বিশ্বমন্দার মধ্যেও আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। স্থানীয় পণ্যের বাজার তৈরি হয়েছে। আমাদের সরকারি-বেসরকারি খাতে অবকাঠামো নির্মাণ বেড়েছে। ফলে সিমেন্টের চাহিদা বেড়েছে। স্থানীয় অনেক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে।
আমাদের ওষুধ খাত অনেক উন্নতি করেছে। বেসরকারি খাতে অনেক হাসপাতাল হয়েছে। আমাদের তৈরি ওষুধ ১৭০টি দেশে রফতানি হচ্ছে এখন। এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই বিশ্বাস। আমরা রেগুলেটেড বাজারেও প্রবেশ করেছি। দেশের দুটি (বেক্সিমকো ও স্কয়ার) বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইউএসডিএফএ) অনুমোদন পেয়েছে।
চামড়া খাতে আমাদের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। আমাদের গার্মেন্ট খাত উন্নতি করছে দ্রুত। তাজরীন ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আমাদের গার্মেন্ট খাত অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিজিএমইএর ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট এবং তার সদস্যরা অনেক কাজ করছেন। বিজিএমইএকে আরো গ্রাহকবান্ধব ও মিডিয়াবান্ধব এবং সেখানে শ্রমিকদের গুরুত্ব দেয়ার কাজ চলছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। এখন মান নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এখনো কারিগরি শিক্ষা নিয়ে খুব একটা কাজ করতে পারিনি। সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। একমুখী শিক্ষা, শিক্ষকের মানোন্নয়ন প্রভৃতি দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষকের মানোন্নয়নে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী আমেরিকা, ভারত ও চীনের সাহায্য চেয়েছেন। আমরা বুঝতে পারছি শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারব না।
শিল্পোৎপাদন বাড়াতে হবে। শিল্পোৎপাদন বাড়াতে আমাদের উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি রোধ এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হচ্ছে এবং শিক্ষক নির্বাচন কীভাবে করা হচ্ছে, সেদিকেও নজর দিতে হবে।
আমাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আগে এতটা নজর না দিলেও এখন দিতে হবে। কেননা আমাদের বিদেশী বিনিয়োগ অনেক বেশি আসছে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ এবং বিনিয়োগ কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের বিপুল সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার দরকার কিন্তু আমরা তা পাচ্ছি না। সেক্ষেত্রে আমাদের আরো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ তৈরি করতে হবে।
আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১১ শতাংশে দাড়িয়েছে। এটা আমাদের জন্য সুসংবাদ। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। গ্রাম পর্যন্ত প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে। কৃষিপণ্যের সাপ্লাই চেইন দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের ফার্ম ও নন-ফার্ম দুই ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ বাড়ছে। বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। গবেষণা খরচ আরো বাড়াতে হবে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানীরা যদি এখানে এসে কাজ করেন, তাহলে আমাদের আরো উন্নতি হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে রেমিট্যান্স আরো বাড়বে। তাদের কর্মক্ষেত্রও বাড়বে। এক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আরো কাজ করতে হবে।
পল রোমার বলেছেন, ‘we want growth with quality.’ (আমরা গুণগত প্রবৃদ্ধি চাই) বাংলাদেশকে মানোন্নয়নে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আমাদের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গসহ নারী, যাদের একটা অংশ কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না। এরাই চরম দরিদ্র। সরকার তাদের জন্য বৃদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায়। কিন্তু এটি পর্যাপ্ত নয়। এর পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে।
আমাদের চিকিত্সা ব্যবস্থার বাজে অবস্থার শিকার জনসংখ্যার এক বড় অংশ। অপুষ্টিতে ভোগা, ভুল চিকিত্সা, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহতরা আমাদের পেসেঞ্জার পপুলেশন। এক্ষেত্রে গ্রামীণ চিকিত্সা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায় কিনা, তা দেখতে হবে। পিপিপির আওতায় ছোট ছোট হাসপাতাল করা যেতে পারে।
আমাদের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে কিন্তু জীবনের মান বাড়েনি। ঢাকা শহরের বাস ও অটোরিকশা ড্রাইভারদের ৭০ শতাংশের শ্বাসকষ্ট আর তীব্র মাথাব্যথার সমস্যা আছে। আমাদের শহরের অনেকের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি আছে। শহরের পরিবেশ উন্নয়নে আরো কাজ করতে হবে। তা না করলে আমাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো নয়। পাবলিক টয়লেট নেই পর্যাপ্ত। মেয়েদের টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়গুলো খুবই মারাত্মক প্রভাব ফেলছে উৎপাদনশীলতায়।
আরেকটি সমস্যা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। আমাদের ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে গেলে তারা যেকোনো সময়ে ট্যাক্সিতে চলাফেরা করতে পারে। দেশে বিমানবন্দরে নেমেই তাদের চিন্তায় পড়তে হয় কতক্ষণ যানজটে আটকে থাকতে হবে। ট্যাক্সি পাওয়া তো একটা দুঃসাধ্য কাজ। বেশির ভাগই নিরাপদ নয়। আমাদের নিজস্ব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে কাজ করতে হবে। একে কীভাবে উন্নত করা যায়, সেটা ভাবতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট উন্নত হলে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বহুলাংশে কমে যাবে।
বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, আমাদের দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি রেজিম আদিম যুগের। তারা যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে সেটা প্রসেস হতে অনেক সময় ব্যয় হয়। এতে তাদের অনেক সময় নষ্ট হয়। এ সময়ে তারা আরো অনেক কাজ করতে পারতেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বলেছি, অনেক বড় কোম্পানি কাজ করতে চায়, কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসা করতে কী কী লাগবে, জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট, টাকা কীভাবে আনব, এক্সচেঞ্জ রেট পলিসি আছে কিনা, লাভ করলে টাকা কীভাবে ফেরত নেব প্রভৃতি। সুতরাং আমাদের ব্যবস্থার উন্নতি না করলে হবে না। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের দিকে তাকিয়ে আমাদের রেগুলেটরি রিফর্ম করতে হবে। নিজেদের বিনিয়োগকারীদের জন্য হলেও রেগুলেশন ঠিক করা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার উদ্যোগ নেয়া হলেও পরে আর এর বাস্তবায়ন হয়নি।
আমাদের নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে অসামান্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০০৩ সালে আমাদের নারী কর্মশক্তি ছিল ৬ মিলিয়ন, সেটা ২০১৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৬ মিলিয়ন। ১০ বছরে এক কোটি নতুন নারী যুক্ত হয়েছে কর্মক্ষেত্রে। বিশ্বব্যাংক বলছে, কর্মক্ষম নারীর ৩৪ শতাংশ কর্মে নিয়োজিত আর পুরুষের ৮২ শতাংশ। এই ৩৪ শতাংশকে যদি পুরুষের সমান করতে পারি, তাহলে আমরা অনেক এগিয়ে যাব। এক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। যশোর, নোয়াখালী, দিনাজপুরে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে হবে। গ্রামীণ স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল উন্নয়ন করতে হবে। আগেই বলেছি, গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করার দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। পিপিপির আওতায় সে প্রকল্প করা যেতে পারে।
রেলওয়ে আরো উন্নত করা প্রয়োজন। নদীপথকে আরো উন্নত ও সহজলভ্য করা প্রয়োজন। আমরা রেলের উন্নয়ন দেখতে পারছি না। প্রয়োজনে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে একটি বিশেষ ট্রেড করিডোর করা। নদীপথে ড্রেজিং করে পণ্য পরিবহনকে আরো সহজলভ্য করার পাশাপাশি সড়কের ওপর চাপ কমানো দরকার।
সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে আমাদের সরকারের আয় বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করতে হবে। যারা কর দেয়, তাদের বারবার চাপ দেয়া হচ্ছে আর তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিডার সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। সরকারি লোকসান কমাতে আমাদের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নসহ দক্ষতা বাড়াতে হবে। সেখানে দক্ষ মানুষদের নিয়োগ দিতে হবে। সেখানে বিসিএস কর্মকর্তা ছাড়াও নিয়োগের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিয়োগ না দিলেও তাদের টাস্কফোর্সে জায়গা দেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্নদের নিয়োগ দিয়ে আইনকানুন ঢেলে সাজাতে হবে। বিচার ব্যবস্থা আধুনিকায়ন প্রয়োজন। স্থগিত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা পাচার হয়ে যাওয়ায় আমরা চিন্তিত হলাম। অনেক দৌড়াদৌড়ি করলাম। কিন্তু আমরা তার চেয়ে অনেক কম চিন্তিত বাংলাদেশ ব্যাংকে ১২ হাজার কোটি টাকা অডিট আপত্তি নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবার ক্ষতির সম্মুখীনও হয়েছে। তাদের ব্যালান্সশিটে প্রথমবারের মতো লোকসান হয়েছে। এগুলো নিয়ে আমরা ভাবছি না। বিপিসি, পেট্রোবাংলা, তিতাস গ্যাসের মতো ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আয় করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা অপচয় রোধ করবে, টাকা বাঁচাবে। সেই টাকায় আমরা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল স্থাপন করতে পারতাম।
আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা এখন প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের কীভাবে উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করব— সেটা ভাবতে হবে। তাদের বেশির ভাগ দেশের বাইরে পড়তে যাবে। তাদের দেশে এনে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা ভাবতে হবে। নিয়োগ বাণিজ্যে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শিক্ষকদের কাছ থেকে আর কিছু আশা করা সম্ভব হবে না কয়েক বছর পর। আমরা যদি শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন না আনতে পারি, তাহলে আমাদের অনেক বেশি ভুগতে হবে।
আমরা একসময় ভারত থেকে লোক আনতাম। তারা নিজেরা এখন তাদের বাজার তৈরি করেছে। তারা এখন আমাদের লোক দিতে পারছে না। এতে খরচও বাড়বে। নিজেদের লোক বেকার হবে। সুতরাং আমাদের জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তুলতে হবে। ইপিজেডে আমাদের শ্রমিক সংকট বেড়েছে। বেশি বেতন ভাতা দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ার সংকটেও ভুগছি আমরা।
বাংলাদেশ ব্যাপক সম্ভাবনাময়। সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এটাকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সুশাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষেত্রে যাকে নিয়োগ দেয়া হবে তার আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা আছে কিনা, বর্তমান বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা আছে কিনা কিংবা অন্যদের সাফল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিনা তা দেখতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ চালাবেন রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষেত্রে হতে হবে শিক্ষিত এবং আধুনিক মানুষ। তা না হলে আমরা জনগণের দরজায় সেবা পৌঁছে দিতে পারব না। আমাদের অপচয় বাড়বে। আমরা পিছিয়ে পড়ব। আমাদের সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না। সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত থেকে ছিটকে পড়ব আমরা।
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক