অভাবের সংসার। প্রতিদিন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। স্বামী মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, কিন্তু তাতেও তো সংসার চলে না। গৃহবধূ হাফিজা কিছু একটা করার কথা ভাবেন। একদিন জানতে পারেন ফুল চাষ করে অনেকেই লাভবান হচ্ছে। ব্যস, ২০০১ সালে সাত হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ৭ শতক জমির ওপর বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু করেন। সে সময় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের চারা বিক্রি করে কিছু টাকাও আসে তাঁর। এরপর ঋণ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন জারবেরা ফুল চাষ।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি হাফিজাকে। মাঠভরা জারবেরা ভুলের গন্ধে সংসারের অভাব দূর। শ্রম আর মেধায় তাঁর ক্ষুধার পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ফুলের বাগানে হাসছে নানা রঙের জারবেরা। সেই ফুল বিক্রি করে তিনি সচ্ছলতা এনেছেন পরিবারে। এখন গ্রামে তাঁকে ‘ফুলের রানি’ বলে সবাই ডাকে।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসরা গ্রামে তাঁর বাড়ি। ২০০৪ সালে স্বামী ইসমাইল হোসেন কলকাতায় গিয়ে জারবেরা ফুলের টিস্যু কালচারের কয়েক শ চারা নিয়ে আসেন। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে ১০ শতক জমিতে বাণিজ্যিকভাবে জারবেরা ফুলের চাষ শুরু করেন। হাফিজার হাতের ছোঁয়ায় জারবেরা ক্ষেত ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফুলের স্টিক কেটে প্যাকেটজাত করেন। ইসমাইল রাতের গাড়িতে ঢাকার শাহবাগে গিয়ে সেই ফুল বিক্রি করে বাড়ি ফেরেন। বর্তমানে পাঁচ বিঘা জমিতে জারবেরার চাষ হচ্ছে। প্রতি মাসে ১৩ থেকে ১৫ হাজার জারবেরা বিক্রি করেন হাফিজা। এ থেকে মাসিক লাভ হয় ৪০ হাজার টাকা।
কেবল হাফিজা নন, এই ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পানিসরা গ্রামের আলী সরদার, আব্দুর রাজ্জাক, মিলন, লিয়াকত জারবেরা চাষে এগিয়ে এসেছেন।
নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ২০০৮ সালে হাফিজাকে যশোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে পিকেএসএফ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আরআরএফ ও প্রকাশুর তাঁকে কম্বোডিয়ায় নিয়ে যায়। হাফিজা কম্বোডিয়ার চাষিদের কাছে তাঁর সাফল্যের গল্প শোনান। তাদের ফুল চাষ শিখিয়ে দেন। চলতি বছর ইউএসএআইডি হাফিজাকে ফুল চাষের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি ২১ দিন অবস্থান করে আটটি প্রদেশ ঘুরে হাতেকলমে ফুল চাষ শিখেছেন। এখন তাঁর ফুলের বাগানে ছয়জন কর্মচারী রয়েছে।
জানা যায়, জারবেরা অ্যাসটারেসি পরিবারভুক্ত একটি বাণিজ্যিক ফুল। জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী ট্রাউগট জারবারের নাম অনুসারে এ ফুলের নামকরণ করা হয় কারবেরা। কিন্তু আমাদের দেশে এই ফুলকে বলা হয় জারবেরা। আফ্রিকা অঞ্চলে এই ফুলের নাম ডেজি। ইউরোপেও একই নামে পরিচিত। জারবেরা গণের আওতায় ৪০টির মতো প্রজাতি আছে। পৃথিবীব্যাপী এই ফুল কাট ফুল হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জারবেরা ফুলের বারি জারবেরা-১ ও বারি জারবেরা-২ নামের দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশের মাগুরা, টাঙ্গাইল, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এই ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, টিস্যু কালচারের মাধ্যমে জারবেরা ফুলের চাষ খুবই লাভজনক। এক বিঘা জমিতে সারা বছর ধান, পাট, সবজিসহ অন্যান্য ফসলের চাষ করলে ৫০ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু জারবেরা চাষে সমপরিমাণ জমি থেকে খরচ বাদে পাওয়া যায় পৌনে ছয় লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে হাফিজা কালের কণ্ঠকে বলেন, “প্রথম প্রথম অনেকে অনেক কথা বলেছে। আমি ঘরে দরজা দিয়ে নীরবে কেঁদেছি। একপর্যায়ে চোখের পানি মুছে ফুলের ক্ষেতে নেমেছি। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে জারবেরা ফুলের চাষ করেছি। আমার দুই ছেলে লেখাপড়া করছে। সংসার থেকে অভাবকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছি। ফুল আমাকে ‘রানি’ বানিয়েছে।”
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘হাফিজা গদখালী এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম জারবেরা ফুলের চাষ করে ইতিহাস হয়েছেন। মেধা আর পরিশ্রমে তিনি একজন সফল ফুলচাষি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন তিনি অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস।’