এলো নবান্ন : ঘরে ঘরে পিঠাপুলির ঘ্রাণনিজস্ব প্রতিবেদক: আজ অগ্রহায়ণের প্রথম দিন। দেশের গ্রামাঞ্চলে শুরু হচ্ছে নবান্ন উত্সব। গ্রামীণ জনপদে বাঙালি, কোচ, মান্দি, হাজংসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ‘নবান্ন’ ধান কাটার প্রধান উত্সব। অগ্রহায়ণে বাংলার প্রধান কৃষিজ ফল কাটার সময়। নবান্নে নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার; বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে। পশ্চিমাঞ্চলের জেলা কুষ্টিয়ায় আখের গুড়, নারিকেল, নতুন ধানের আতপ চালের ক্ষীর রান্না করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। উত্তরের জেলাগুলোয় জামাই-মেয়েকে নিমন্ত্রণ করে পিঠা-পায়েস খাওয়ানো হয়। নাইওর আনা হয় মেয়েকে। অন্যদিকে মাঠে মাঠে নতুন সোনা ধান। উপকূলীয় পটুয়াখালীর বাউফলের বিভিন্ন গ্রাম ও চরএলাকা থেকে মুছে যায়নি গ্রামবাংলার শাশ্বত অনুষ্ঠান ‘নয়াখাওয়া’ বা নবান্ন। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনের কৃষাণ-কৃষাণির কৃষি সংস্কৃতি ‘নয়াখাওয়া’। আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয় নতুন ধানের চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠে-পায়েস, শিরনি।
দেশি ধানের জাত হারানো ও আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে নবান্ন উত্সব হারাতে বসেছে। শতাধিক দেশি জাতের আদি ধান সংরক্ষক রাজশাহীর তানোর
উপজেলার দুবাইল গ্রামের কৃষক ইউসুফ মোল্লা জানান, দুবাইল গ্রামে দেশি জাতের আমন মুগি ধান কাটার পর নবান্ন উত্সব পালিত হতো। বেশ কয়েক বছর আগে মুগি ধান চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে নবান্ন উত্সবও বন্ধ হয়ে যায়। মুগি ধানের জায়গা উফশী জাতের ধান দখল করে নিয়েছে। ধান কাটার সময় তাই পরিবর্তন হয়েছে, উত্সবেও পড়েছে ভাটা। তিনি বলেন, নবান্নের সঙ্গে তানোর অঞ্চল থেকে ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে ঝিঙাশাইল, রগুশাইল, সোনাকটি, কদমশাইল, ঝুলন, ধারাম, কার্ত্তিকশাইল, কাশিপুলিসহ অনেক ধান। গ্রামগুলোতে এসব ধান কাটার পর নতুন ধানে পিঠাপুলি, গুড়ের ক্ষীর দিয়ে নবান্ন পালিত হতো।
দেশের মানুষের মনে নতুন আমন ধান কাটার উত্সব ‘নবান্ন’ সবার প্রিয় বলে জানান প্রাণ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ। তিনি বলেন, তিনটি প্রধান ধানের মৌসুম হলেও অগ্রহায়ণে নতুন আমন ধানকে বরণ করতে নবান্ন উত্সব পালন করা হয়। আমন ধান কাটার আগে কার্তিকে কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো। তবে বাংলাদেশের সব সম্প্রদায়ের উত্সব নবান্ন। এটি বাংলার কৃষি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অন্যতম বড় উত্সব। বাঙালিদের কাছে তাই নবান্ন, কোচদের কাজে ‘গেটেল চাওয়া’, মান্দিদের কাছে উয়ান্না, হাজংদের কাছে ‘নয়াখাওয়া’। নবান্ন এক ধরনের খাবারের নাম। নতুন চালের গুঁড়া, নারিকেলের রস, দুধ, ঘি, মধু দিয়ে তৈরি এই ধরনের খাবারের নামই ‘নবান্ন’। দেশের দক্ষিণের উপকূলের জেলাগুলোতে এখনও এই খাবারে নবান্ন পালন প্রচলিত আছে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায়, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’ প্রকৃতি রূপ-রসে ভরে ওঠে চারপাশ, কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক আর কৃষকের গোলায় উঠছে পাকা ধান। তবে অঞ্চলভেদে সুনির্দিষ্ট ধানে নবান্ন তৈরি করে মানুষ।
পার্থ জানান, নবান্ন উত্সবের জন্য খুলনা ও সারক্ষীরা অঞ্চলে মইয়নাশাইল ধানের চাল দিয়ে নবান্ন তৈরি হয়, নেত্রকোনার হাজংরা হাতিবান্দা ধান দিয়ে, মান্দিরা মিদিম ধানের চাল দিয়ে নবান্ন উত্সব পালন করে থাকে। এছাড়াও শেরপুর অঞ্চলের কোচ জনগোষ্ঠী পুরাবিনি দান দিয়ে নবান্ন উত্সব করে। তাই নির্দিষ্ট স্থানীয় জাতের ধান হারিয়ে গেলে নবান্ন উত্সব ম্লান হয়ে পড়ে।
এদিকে আজ জাতীয় নবান্ন উত্সব উদযাপন পরিষদ আয়োজন করেছে নবান্ন উত্সব। সকাল ৭টা ১ মিনিটে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় জাতীয় নবান্ন উত্সব-১৪২৩ উত্সব শুরু হবে। আবার বিকেল ৩টা থেকে বকুলতলা ও ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চে উত্সবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। উত্সবে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নবান্ন শোভাযাত্রা, আদিবাসী পরিবেশনাসহ বিভিন্ন পরিবেশনা থাকবে। থাকবে ঢাক-ঢোলের বাদন আর মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা ও পিঠার আয়োজন। এই বছরের উত্সবের উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। জাতীয় নবান্ন উত্সব উদযাপনে সহযোগিতা করবে ল্যাবএইড।