আগামী দুই মাসে শক্তিশালী দুই দেশের দু’জন প্রভাবশালী রাজনৈতিক অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাবে বাংলাদেশ। তাদের সঙ্গে থাকবেন দেশ দুটির অর্থনৈতিক ভুবনের কর্তাব্যক্তিসহ একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশে তাদের বাণিজ্যিক বাস্তবতা ও বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারিত হবে এই দুই সফরে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিন জো আবে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিংয়ের সফর এবং নানা চুক্তির পর ডিসেম্বর ও নতুন বছরের জানুয়ারিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে বিদেশি বিনিয়োগের বিশাল বাস্তবতা দেশের অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তি দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সাম্প্রতিকবিশ্ব বাস্তবতায় কূটনৈতিক সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সফরে বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের ঝুড়িতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। পাশাপাশি এই সফর সরকারকে রাজনৈতিকভাবে আরও সুদৃঢ় করবে বলে অভিমত তাদের।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বাংলাদেশ সফরে আসছেন বলে ইরানি দূতাবাস সূত্র নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের পোশাক, ওষুধ, খাদ্যজাত দ্রব্য আমদানির পাশাপাশি সে দেশের গ্যাস, কয়লাসহ বিভিন্ন উৎপাদিত সামগ্রী রপ্তানির লক্ষ্য রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসা দেশটি। এর আগে ২১ বছর আগে ১৯৯৫ সালে ইরানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাস সূত্র জানায়, কেমিক্যাল, প্লাস্টিকের কাঁচামাল, তেল ও সিমেন্টের কিঙ্কারসমৃদ্ধ ইরান এসব খাতে যৌথভাবে বিনিয়োগে আগ্রহী। এ ব্যাপারে হাসান রুহানির আসন্ন সফরে একটি নতুন চুক্তি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ-ইরানের বাণিজ্য সম্ভাবনা এখন দারুণ বলে মনে করে ইরান।
দূতাবাস সূত্র আরো জানায়, ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইরানের জালানি সরবরাহের যে চুক্তি তা সম্প্রসারণ করে বাংলাদেশও এর অংশীদার হয়ে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশকে অশোধিত তেল আমদানিতে বিশেষ সুবিধা দিতে চায় ইরান জানিয়ে সূত্রটি জানায় বাংলাদেশের একমাত্র তেল পরিশোধনকেন্দ্র ইস্টার্ন রিফাইনারির সংস্কার ও সমতা বাড়াতেও সহযোগিতা দেবে দেশটি যা ইরানের সহযোগিতায়ই নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া সিলেটে আবিষ্কৃত বাংলাদেশের তেলক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে ইরান মূলত তেল রপ্তানি, পরিশোধন কেন্দ্রে সহায়তা ও তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানে সহায়তা করে বাংলাদেশের জালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে চায় দেশটি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্য পরমাণু শক্তি নিয়ে যে কাজ করছে তাতেও ইরান সহযোগিতা করতে আগ্রহী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইরানী দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, ইরানের প্রেসিডেন্টের সফরে নানা চুক্তিতে নিশ্চিত হবে বাংলাদশে ইরানের বিশাল অংকের বিনিয়োগ। পাশাপাশি ইরানের বাজারেও বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় প্রবেশদ্বার খুলে যাবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশও দেশটিতে রপ্তানির জন্য একটি বড় বাজার পাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। পারস্য উপসাগরের এ দেশটিকে বলা হয় এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কয়েকটি দেশের একটি। ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী ইরানের অর্থনীতি প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক অবরোধের কবলে থাকার কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই অবরোধ উঠে যাওয়ার কারণে ইরান এখন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারই অংশ হিসেবে দেশটি বাংলাদেশকে রপ্তানি ও আমদানির উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে। এ সুযোগকে কাজে লাগানো গেলে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বাংলাদেশ।
এদিকে গত ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদভের বাংলাদেশ সফরের বিষটি চূড়ান্ত হয়। তবে দিমিত্রি মেদভেদেভের বাংলাদেশে আসার সময়সূচি কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ঠিক করা হবে বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে এ দুই দেশের মধ্যে কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভিসামুক্ত চলাচলের জন্য একটি চুক্তি সই হয়। এছাড়াও সার্বিক দ্বিপক্ষীয় ইস্যু বৈঠকে আলোচিত হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, চূড়ান্ত দিনক্ষণ এখনও ঠিক না হলেও ২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসবেন রুশ প্রধানমন্ত্রী তা অনেকটাই নিশ্চিত।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানা যায়, আন্তঃরাষ্ট্র সহযোগিতা, সামুদ্রিক ও সামরিক সহযোগিতাসহ বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কিছু চুক্তিতে আগ্রহী রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে চলমান আলোচনা এগিয়ে নিতে ও বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ঢাকায় প্রতিনিধিদলও পাঠাতে চায় দেশটি। এছাড়া ২০২১ সালে রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিতব্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রুপপুর পারমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাবে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বরাবরই ভালো। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের সামরিক অস্ত্রও কেনাকাটা হয়। ঢাকায় রুশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের আমন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এর গভীর আগ্রহ রয়েছে। সাধারণত বড় কোনো উপলক্ষ ছাড়া কোনো দেশ সফর করেন না পুতিন। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য এবং রাশিয়ার জন্যও একটি বড় বিষয়। সেটি উদ্বোধনে তার বাংলাদেশে আসার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পরপর সফর বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেবে এবং বর্তমান সরকারকে রাজনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী করবে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আলী শিকদার ভোরের পাতাকে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে সমীহ আদায় করে নিচ্ছে তার গতিশীল নেতৃত্বের কল্যাণে। এখানকার বাজার ও তারুণ্যকে সফলভাবে সারা বিশ্বে উপস্থাপন করছে সরকার। যার ফলে বিনিয়োগ আসছে। আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অনমনীয় অবস্থান বিনিয়োগকারীদের নির্ভার করছে। সাময়িক যে মংকা যে তৈরি হয়েছিল তা পেছনে ফেলে তারা নিজেদেও স্বার্থেই এগিয়ে আসছে। তিনি আরো বলেন, ইরানের প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সফর বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক শক্তিমত্তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
বিনিয়োগের জন্য যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রয়োজন তা বিদ্যমান বলেই চলতি বছর থেকে বিগত দুই বছরের নিম্নমুখী বিদেশি বিনিয়োগ অবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বিশেষ করে চীনা প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং এর ২৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশে আসতে উদ্বুদ্ধ করছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের পাতাকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য যে ধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন তা বাংলাদেশে বিদ্যমান। ফলে বিনিয়োগও বাড়ছে। তবে তিনি বিনিয়োগের এ ধারাকে অক্ষুণœ রাখতে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান আলাপ-আলোচনায় নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সস্তা শ্রমিক ও পণ্যের উচ্চ মানের জন্য বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য অধিকতর আগ্রহী হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশের বর্তমান স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে একই সঙ্গে বাংলাদেশ যেন আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে না পড়ে সে জন্য বিনিয়োগকারীরা সরকারের কাছে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করছে বলে জানা যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর তা দমনে বাংলাদেশ যে সফলতার পরিচয় দিয়েছে তাতে বিনিয়োগকারীরা আরও উৎসাহ বোধ করছে বলেও মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির ভোরের পাতাকে বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান বিদেশি বিনিয়োগ দেশে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়নের পথকে প্রশস্ত করবে। তবে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ না বাড়লে তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনুৎসাহিত করতে পারে। এ বিষয়ে সরকার মনোযোগী হবে বলে মনে করেন তিনি।’ এদিকে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রধানদের ধারাবাহিক বাংলাদেশ সফর ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। নতুন বিনিয়োগ এবং আরও বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবসাতে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ বলেও মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে হামিম গ্রুপের কর্ণধার এবং সাবেক এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ ভোরের পাতাকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখন অনেক বেশি আশাবাদী। তবে বর্তমানে দেশে যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা কোনোভাবেই যেন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।