মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা পাবেন ভাতা ও ফ্ল্যাট

মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য সুখবর আসছে। এমন সাড়ে তিন লাখ নারীকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে ভাতা দেবে সরকার। এরই মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগকারী এসব নারীকে ভাতা দিতে কর্মসূচি নিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। শিগগির তা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পরই এ কর্মসূচি শুরু হবে।
এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত এসব নারীকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এখন থেকে সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে ভবন করে তাদের একটি করে ফ্ল্যাট নামমাত্র মূল্যে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। শিগগির তা চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এর বাস্তবায়ন হলে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী নারীদের প্রতি রাষ্ট্রের কিছুটা দায়মোচন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তার কোনো হিসাব সরকারিভাবে নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে যেসব তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত নারীর সংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়েও সঠিক হিসাব নেই। যদিও এর মধ্যে দেড় শতাধিক নারীকে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আরও কয়েকজন নারীকে ওই উপাধি দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে শুধু বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা নন, ওই সময়ে যেসব নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হবে। ওই তালিকা অনুযায়ী তাদের প্রতি মাসে ভাতা দেওয়া হবে। তবে এ ভাতা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী হিসেবে পাবেন।
এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান সমকালকে বলেন, প্রতিটি উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের তালিকা তৈরি করা হবে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তা নেওয়া হবে। তালিকা অনুযায়ী ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তিনি আরও বলেন, সরাসরি যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের পাশাপাশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন, ১৯৮৫-এর আওতায় একটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। নয়া নীতিমালা অনুযায়ী এখন থেকে কাউকেই সরাসরি সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেওয়া হবে না। এ সম্পত্তির ওপরে ভবন তৈরি করে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি অসহায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি করে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। তবে বাণিজ্যিক ভবন, প্রতিষ্ঠান, দূতাবাস নির্মাণের ক্ষেত্রে বাজারমূল্যে সরাসরি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের সহায়তা করা বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার। আর এটি পূরণেই আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তি প্রদানের নীতিমালায় তাদের আওতাভুক্ত করা হচ্ছে। আর যেহেতু জমি কমে যাচ্ছে, তাই জমির ওপর ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট দেওয়ার বিধান রাখা হচ্ছে এ নীতিমালায়।
জানা যায়, সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ হাজার একর পরিত্যক্ত সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার একর সম্পত্তি লিজ ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে। বাকি সম্পত্তি সরকারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই প্রায় চার হাজার পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে। শুধু মিরপুরেই সরকারি পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে প্রায় দুই হাজার। এসব বাড়ির বেশিরভাগই কাউকে না কাউকে দেওয়া হয়েছে অথবা কেউ জোর করে দখল করে আছেন। সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তি নানা শ্রেণির মানুষকে দেওয়া হলেও আজও মুক্তিযুদ্ধের বীরমাতাদের দেওয়া হয়নি। কোনো সরকারই তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইনেও তাদের দেওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। ফলে নূরজাহান, খোদেজা, আয়শা, আছিয়া ও বাহাতন বেগমের মতো সারাবাংলায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন বাঙালি জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কন্যারা। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একজন বীরাঙ্গনা নিজের গ্রামে আশ্রয় না পেয়ে পাশের এক গ্রামের গোয়ালঘরে গরুর সঙ্গে বসবাস করার ঘটনাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তি পেতে আবেদনের হিড়িক পড়ে। এটি সামাল দিতেই সরকার পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেওয়ার নতুন নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশপাশি নীতিমালা ছাড়া কাউকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেওয়াও স্থগিত রাখা হয়। জানা যায়, নতুন নীতিমালায় সরাসরি কাউকে সম্পত্তি প্রদানে বিধিনিষেধ থাকছে। কাউকে সরাসরি পরিত্যক্ত সম্পত্তি না দিয়ে ওই সম্পত্তির ওপর ভবন তৈরি করে ফ্ল্যাট করে দেওয়ার বিধান রাখা হচ্ছে। তবে এই ভবন সরকারের নিজস্ব অর্থ দিয়ে করা হবে না। কোনো ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে ভবন তৈরি করা হবে। পরে এর থেকে সরকার যে অংশ পাবে, তা থেকে একটি করে ফ্ল্যাট যুদ্ধাহত, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বীরাঙ্গনাদের দেওয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের তালিকা দেবে। ওই তালিকা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তাদের ফ্ল্যাট দেওয়া হবে।