বাংলাদেশের মানচিত্রে উদ্ভাসিত মুখ

ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে শোষণবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এই চার নেতা তখন থেকে সেই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তারা সকলে ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিপক্ষে। কারণ আমলারা বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষাকে দলিত করছিল। এজন্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তাদের কাজ ছিল সংঘবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তাদের লড়াই ছিল বাঙালির ন্যায্য দাবির লড়াই, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আপোসহীন পথযাত্রা। ষাটের দশক থেকে এই চার জাতীয় নেতা তৎকালীন পূর্ববাংলার সমগ্র জনগণকে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; মানুষকে দাবি আদায়ের বিষয়ে আশাবাদী করে তুলেছিলেন। ইসলাম ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান বিশ্বাসী মানুষকে সার্বজনীন গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত করার কৃতিত্ব তাদের। আর মুক্তিযুদ্ধে তাদের নেতৃত্ব সারা বিশ্ববাসীর কাছে ছিল সুউচ্চ ও মহান। স্বাধীনতার পরে সরকার গঠিত হলে তারা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হন।
দেশের স্বার্থ ক্ষুণœ না করে মানুষের মঙ্গলাকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত ছিলেন তারা। ভালো রাজনৈতিক মাত্রই ভালো প্রশাসক হবেন এটা ঠিক নয়; তবে তারা সে যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন। কারণ তারা কেউ ষাটের দশকের আদর্শবাদী রাজনীতির বাইরে চলে যাননি। বরং একটি অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজগঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন; বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বাকশালের পতাকাতলে একত্রিত হয়েছিলেন। কারণ তখনো বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের দেশ। কিন্তু পুরনো শত্রুরা সক্রিয় ছিল তখনো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু সরকারের নীতিকে পছন্দ করত না। দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের নানান তৎপরতা চলতে থাকে। এরই পরিণতিতে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা। এরপরই পাকিস্তানি ঘরানার ইসলামি রাজনীতি পুনর্বহাল হয় বাংলাদেশে।
সেই সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পেছনে কিছু সেনাকর্মকর্তার ক্ষমতার লোভ প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিল। ১৫ আগস্টের ঘটনার পরে খালেদ মোশাররফ মোশতাকের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা করে জিয়াকে সরিয়ে দিয়ে নিজে স্বঘোষিত ‘মেজর জেনারেল’ হন। এরপরই তিনি নিজে সামরিক আইনশাসক ও মোশতাককে সরিয়ে ওসমানীকে রাষ্ট্রপতি করার পরিকল্পনা করেন। ওসমানী রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মত হওয়ায় প্রধান বিচারপতি সায়েমকে লোক দেখানো রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। মোশতাক-মোশাররফের ক্ষমতার লড়াইয়ের সময়ই জেলহত্যা ঘটেছে। অর্থাৎ ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদীদের ক্যু ও পাল্টা ক্যু চলছিল তখন। জেলহত্যার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত ছিল অথবা ওই ঘটনার সমর্থক ব্যক্তিদের নিয়ে জিয়া ও এরশাদ ১৩ বছর রাজনীতি করেছেন। তাদের সেই রাজনীতির ধারাটি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান নিজেই ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে তথ্য-প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। এজন্যই কি তিনি সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ঘাতকদের বিচারের সামনে দাঁড় করানো থেকে বিরত থেকেছিলেন? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন?
ইতিহাসের জঘন্য ও নৃশংস এ হত্যাকা-ের ঘটনায় ১৯৭৫ সালেই লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনাকর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদ- এবং অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়।
কিন্তু ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের মৃত্যুদ- বহাল রেখে অন্যান্য মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের খালাস দেওয়া হয়। তবে জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অপর আট যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া আসামি সম্পর্কে কোনো মতামত না দেওয়ায় তাদের দ- বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তবে জেল হত্যাকা-ের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যসহ আমরা এ রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। একইসঙ্গে রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়েছে। কারণ জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নির্মম এ হত্যাকা-ের পুনঃতদন্ত ও পুনঃবিচার নতুন প্রজন্মের দাবি ছিল বলেই বর্তমান সরকার সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
সংসদীয় গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার এখন ক্ষমতায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করেছিল, ‘জেলখানায় চার নেতার হত্যাকা-ের পুনর্বিচার করা হবে।’ জেলহত্যার নির্মম বলি মহান ব্যক্তিরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারার সমর্থক। তাদের হত্যার বিচার ও দোষীদের শাস্তি বিধানের মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক ধারা সমুন্নত রয়েছে এবং তাদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান