বান্দরবানের লামা উপজেলাসহ তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে কমলার চাষ অর্থনীতির নতুন বুনিয়াদ গড়ছে। আর্থিক সচ্ছলতার অপার সম্ভাবনা দেখে পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিরাও কমলা চাষে ঝুঁকছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী চলতি মৌসুমে লামা উপজেলায় ১০৯ হেক্টর পাহাড়ি ভূমিতে কমলার চাষ হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এর পরিধি দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক সময় এখানের পাহাড়গুলোতে ফলদ, বনজ গাছের বাগান ও জুমের ব্যাপক আবাদ হতো। বেশ কয়েক বছর ধরে কমলার অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে এ উপজেলাসহ তিন পার্বত্য জেলা। এখানের অধিকাংশ পাহাড় এখন কমলার থোকায় ভরে উঠেছে। সর্বত্র সচরাচর বিক্রি হচ্ছে উৎপাদিত টস্টসে এসব রসালো কমলা। এখানের কমলার স্বাদ ও আকারের দিক থেকে বিদেশ থেকে আমদানি করা কমলার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তাই দিন দিন কদর বাড়ছে কমলার।
এছাড়া এখানকার পাহাড়ের মাটি, আবহাওয়া কমলা চাষের উপযোগী। প্রতিদিনই এখানে উৎপাদিত কমলা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় ৬শ’ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেয়ার মাধ্যমে পাহাড়ে কমলাসহ মিশ্র ফল চাষের প্রক্রিয়া শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটি ছিল পার্বত্যাঞ্চলে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের কমলা ও মিশ্র ফসল চাষ। প্রকল্পে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে ৬শটি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। তাদের ৪৫০টি কমলা, ৯০০টি কফির চারা, ৪৫০টি পেঁপে, ১ হাজার ৫০০টি কলা এবং ৩ হাজার আনারস চারা দেয়া হয়।
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় পরিকল্পিতভাবে কমলা চাষ শুরু হয়। লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় পাহাড়িরা এখন জুম চাষের পরিবর্তে কমলা, মাল্টাসহ মিশ্র ফল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইডেনপাড়া, মুন্নমপাড়া, বেথেলপাড়া, এথেলপাড়া, বগালেকপাড়া, কৈক্ষ্যংঝিড়ি, পাইন্দু, রনিন পাড়া মুরংগ পাড়া, শঙ্খমনিপাড়া, থানচি উপজেলার অ্যাম্পু পাড়া, কুনাংপাড়া, জিনিংঅং পাড়া, মঙ্গীপাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার বেতছড়া, গালেঙ্গ্যা, ঘেরাও, দোলিয়ামপাড়া, পোড়াপাড়া, লামা উপজেলার গজালিয়া, ফাঁসিয়াখালী, রুপসীপাড়া, লামা সদর ইউনিয়ন, আলীকদম উপজেলার লাংদি মুরুংপাড়া, কলারঝিরি, কাইন্দালা ঝিরিপাড়া এবং জেলা সদরের স্যারনপাড়া ও লাইলুনপি পাড়া এলাকায় গড়ে উঠেছে সাড়ে তিন শতাধিকেরও বেশি কমলা আর মাল্টা বাগান। চলতি বছর জেলায় প্রায় ৩৭০ হেক্টর জমিতে কমলা উৎপাদিত হয়েছে।
লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের লেবু পালং এলাকার চিন্তাবর পাড়ার কমলা চাষী সোচিং মুরুং জানান, ৩ একর পাহাড়ে কমলা আবাদ করেছেন। প্রথম বছর একর প্রতি বীজ সংগ্রহ, চারা পলিব্যাগ করা, জায়গা পরিষ্কার, কীটনাশক ও শ্রমিক বাবদ ৩০ হাজার টাকা খরচ হলেও ৫/৬ বছর পর একে একে কমলা ধরা শুরু করে। অবৈজ্ঞানিকভাবে বীজ সংগ্রহ করে পাহাড়ের মাছাংয়ের ওপর পলিব্যাগ করে চারা উৎপাদন করে শেষে পাহাড়ে চারা লাগিয়ে থাকেন চাষীরা। পরে প্রতি সপ্তাহ অন্তর অন্তর কমলা উত্তোলন করে বিক্রি করা যায়। তিনি এক একর কমলা বিক্রি করে পেয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ টাকার বেশি। এ অঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পরিকল্পিতভাবে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কমলা চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। লাভজনক হওয়ায় জুম চাষের পরিবর্তে কমলা চাষে আগ্রহী হচ্ছে পাহাড়িরা। স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে উপজেলার কমলা এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে।
সরই ইউনিয়নের লুলাইং এলাকায় উৎপাদিত কমলাগুলো খুবই সুস্বাদু এবং সাইজে বড়। বাগানের কয়েকশ কমলা গাছে ৫০ হাজারেও বেশি কমলা ধরেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা চাষীদের অগ্রিম টাকা দিয়ে পাইকারি দামে কমলা বাগান কিনে নিচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সুবিধা না থাকায় ফড়িয়াদারদের কাছে দামমাত্র মূল্যে কমলা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে চাষীরা। বর্তমান বাজারে প্রতিটি কমলা ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা দুর্গম থেকে একশ কমলা কিনছে মাত্র চারশ থেকে পাঁচশ টাকায়।
পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি মাটি কমলা চাষের উপযোগী। বাম্পার ফলনের পরও অগ্রিম বাগান কিনে নেয়ায় ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা রঙ আসার আগেই থোকায় থোকায় ছোট কমলা ছিঁড়ে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে উৎপাদিত কমলার স্বাদ অনেক কমে যাচ্ছে এবং খেতে একটু টক লাগছে। কমলাগুলো বড় হওয়ার সুযোগ দিলে এবং সঠিক পরিচর্যায় কমলা বাগান সংরক্ষণ করা গেলে একদিন কমলা চাষের জন্য বিখ্যাত হবে অত্র উপজেলাসহ তিন পার্বত্য জেলা। কমলা বিক্রির মাধ্যমে আরো শত শত চাষী স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন। তবে পচনশীল এ ফলের যথাযথ সংরক্ষণাগার না থাকায় তারা আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছেন চাষীরা।
কমলাসহ মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাত এবং বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর ২০-২৫ লাখ টাকার কমলা বাগানেই পচে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে চাষীরা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।