১০ বছরে নারী জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে ছয় গুণ

রাজিয়া বেগম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বিজয়নগরের বাসিন্দা। ১০ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী মোস্তফা হোসেন দুটি পা-ই হারান। পঙ্গু স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান এই গৃহবধূ। অবশেষে সশরীরে নামেন জীবনযুদ্ধে। দুই বছর আগে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের স্থানীয় প্রতিনিধির সহায়তায় সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সেখানে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে রোজগারের অর্থে দেশে নতুন ঘর তোলেন। বড় মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দেন। চলছে ছেলের লেখাপড়ার জোগান। প্রবাসে কঠোর শ্রমের বদৌলতে রাজিয়ার পরিবারে ফিরেছে সুখ ও সচ্ছলতা।

সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে শত প্রতিকূলতার পরও রাজিয়ার মতো অনেক নারীই বিদেশগামী হচ্ছেন। গত আড়াই দশকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন পাঁচ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭১ জন নারী। তাঁদের অনেকেরই ভাগ্য বদলাচ্ছে। তবে বিপরীত ঘটনাও কম নয়। বিদেশে মালিকের অমানুষিক নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকেই খালি হাতে দেশে ফিরেছেন। তার পরও ভাগ্যান্বেষী নারীদের বিদেশ যাত্রা থেমে নেই। প্রতিদিনই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন শত শত নারী শ্রমিক। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সমপ্রতি বিদেশে পুরুষ কর্মী প্রেরণে কিছুটা ভাটা পড়লেও নারীদের হার বেড়েছে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক রপ্তানি বেড়েছে ছয় গুণ। ১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এক যুগে বিদেশে গেছেন মাত্র ১৮ হাজার ৭৮৫ জন নারী। সেখানে শুধু ২০০৪ সালেই বিদেশে নারী শ্রমিক যাওয়ার হার বেড়ে যায় পাঁচ গুণ। ২০০৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৪৫ জন। আর ২০১৫ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৭১৮ জনে। অর্থাৎ এক দশকে বিদেশে নারী শ্রমিক যাওয়ার হার বেড়েছে ছয় গুণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে পাঠানো হয়েছে ৯১ হাজার ৪৪৮ জন নারীকে। বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে এ বছর গত বছরের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, গত বছর সৌদি আরবে গেছেন মাত্র ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী কর্মী। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে পাঠানো হয়েছে ৫২ হাজার ৬২৬ জন নারী কর্মী। এই হার গত বছরের আড়াই গুণ। এ ছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জর্দানে ১৭ হাজার ৩২৫, ওমানে ১০ হাজার ১২০, কাতারে চার হাজার ৪৬০ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চার হাজার ৭৬ জন নারী কর্মী পাঠানো হয়েছে। বিদেশে যাওয়া নারীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গৃহকর্মী। কিছু যাচ্ছেন গার্মেন্টকর্মী হিসেবে। জর্দানে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার নারী কর্মী পোশাকশিল্প খাতে কাজ করছেন।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সৌদি আরবের মতো বিশাল শ্রমবাজার ধরে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা ও নির্ভরতার জন্য একজন নারী কর্মীর সঙ্গে একজন পুরুষও সৌদি আরবে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আরো একজন রক্ত সম্পর্কীয় পুরুষকে বোনাস কর্মী হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। এ কারণে চলতি বছর থেকে সৌদি আরবে নারী কর্মী রপ্তানি অনেকটা বেড়ে গেছে।

নারী কর্মী রপ্তানি বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন জনশক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খুব কম খরচে বিদেশে যাওয়া যায় এবং থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যয় মালিক বহন করে থাকেন। অভিবাসী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘দেশের দরিদ্র নারীরা এখন অনেক বেশি বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন। তাঁরা দেখছেন, দেশে কঠোর পরিশ্রম করলেও আয় খুবই সীমিত। সমপরিমাণ পরিশ্রমের বিনিময়ে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত হলে বিদেশে যাওয়াটাই ভালো। এমন ধারণা থেকে নারীদের বিদেশে যাওয়ার হার বেড়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নারীদের বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে। তবে যেসব নারী বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন তাঁদের মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে হবে মন্ত্রণালয়কে, যাতে বিপদে পড়লে নারীরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেন। এ জন্য নারীদের নিজ দূতাবাসের নম্বর বাধ্যতামূলকভাবে মুখস্থ রাখার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।’

এ ব্যাপারে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (বহির্গমন) এ কে এম টিপু সুলতান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সৌদি আরবে প্রত্যেক নারী যেন নিজেকে নিরাপদ মনে করেন সে জন্য একজন করে নিকটাত্মীয় পুরুষ সঙ্গে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী। সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে সাড়া দেওয়ায় এখন সমসংখ্যক পুরুষ কর্মীও সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে একজন করে বোনাস কর্মী যাওয়ার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সৌদি আরবে নারী কর্মী যাওয়ার হার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও নারী কর্মী যাওয়ার হার বেড়েছে।’