বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতির চিত্র

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন অনেক সুখবর। সর্বশেষ সুখবর দুটো। একটি প্রবৃদ্ধির হারের ওপর এবং অন্যটি ব্যবসায় সক্ষমতার ওপর। এই দুই সুখবরের পূর্বে বড় দুটো সুখবর, বলা যায়, আকাশচুম্বী সুখবর ছিল চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফর এবং তার পরই ছিল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর। বলাই বাহুল্য এসব খবর একটার সঙ্গে আরেকটা গাঁথা। গাঁথা মূলত আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করছে, খুবই ভালো করছে এর স্বীকৃতি দিয়েছেন চিনা প্রেসিডেন্ট। তিনি ৪০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করে গেছেন। করেছেন তখনই যখন বাংলাদেশ সাত শতাংশের ওপর হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। আর এসব তো হাওয়া থেকে পাওয়া নয়। এটা বোঝা যায় সর্বশেষ আনন্দ-সুসংবাদে। গত বুধবার কাগজে দেখলাম বাংলাদেশের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। একইদিনে আরেকটি ছোট্ট খবর আমাদের ব্যবসায়িক সক্ষমতার ওপর। বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর ‘ডুইং বিজনেস’ এই শিরোনামে একটা সমীক্ষা করে। এতে থাকে বিভিন্ন দেশের সূচক। অর্থাত্ কোন্ দেশে ব্যবসা সহজে করা যায়, কোন্ দেশে তা কঠিন এই নিরিখে বৈশ্বিক খবর। এতে বিনিয়োগকারীরা বোঝেন কোন্ দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করতে হবে। এমন ধরনের সূচকে বাংলাদেশ এক বছরে এগিয়েছে দুই ধাপ। আমরা ছিলাম ১৭৮-এ। আজ এবার উঠেছি ১৭৬ -এ। ধাপ দুটো, কিন্তু এর গুরুত্ব অসীম, আমরা এগোছি। এগোচ্ছি অতিদারিদ্র্য দূরীকরণে, এগোচ্ছি জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জনের হারে যা ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এই ধরনের হার আরেক বার অর্জিত হয়েছিল কয়েক বছর আগে। কিন্তু তা ছিল হিসেবের ভিত্তি বছর পরিবর্তনের ফলে। গেলো বারের প্রবৃদ্ধির সম্পর্কে বলা হয়েছিল প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। তখন হিসেবটি চূড়ান্ত ছিল না। নয় মাসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। এখনকার হিসাবটি চূড়ান্ত বারো মাসের ভিত্তিতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই অসামান্য অর্জনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং তিনি দেশবাসীকে এই অর্জন উপলক্ষে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের এই অর্জনের বড় কৃতিত্ব শিল্প ও সেবাখাতের। এই দুইখাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। দুশ্চিন্তার খবর অবশ্য কৃষির। কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অবশ্য এ ব্যাপারে কথা আছে। বিশ্বের দেশে দেশে আজকাল শিল্প ও সেবাখাতের প্রসারই বেশি ঘটছে। এই বিবেচনায় আমাদের কৃষিতে ‘পারফরম্যান্স’ ভালোই। চলতি মূল্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির মূল্য বা আকার ছিল ১২ লক্ষ ৩২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। যে ১৫টি খাত ও উপখাতের হিসেব ‘জিডিপি’ তে থাকে তার সবগুলোই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে— কোথাও কম, কোথাও বেশি। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বেশি অর্জিত হলেও পরিকল্পনা মন্ত্রী জানিয়েছেন, মাথাপিছু আয় ডলারে মাত্র এক ডলার হ্রাস পেয়েছে এর কারণ টাকার বিনিময় মূল্য ডলারের বিপরীতে হ্রাস পেয়েছে অর্থাত্ ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ হিসেবে ডলারে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলার। বলা বাহুল্য এসব হিসেবই বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (বিবিএস) যা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন।

 

কাগজে দেখেছি সর্বশেষ প্রবৃদ্ধির হারকে কিছুটা অতিরঞ্জিত বলে আখ্যায়িত করেছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ। এই বাদানুবাদে আমি যাব না কারণ প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায় ‘মিডিয়াবান্ধব’ অনেকে এসব তর্ক তোলেন। পরে দেখা যায় সবাই সরকারের তথ্য ধরেই এগোয়। আমার কাছে প্রবৃদ্ধির ইস্যুতে ভিন্ন একটা বিষয় বেশি গুরুত্ব বহন করে। পরিষ্কার আমরা দেখতে পাচ্ছি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার পরও দেশে প্রায় দুই কোটি লোক অতি দরিদ্র। ২০১৬ সালের জুনে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ছিল ২৩ শতাংশ অর্থাত্ চার কোটির উপরে। কথাটা এখানেই নিরলস চেষ্টা করেও অব্যাহতভাবে ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পরও দেশের চার কোটির ওপরের সংখ্যক লোক দরিদ্র মানে দুই বেলা ভাত পায় না। অথচ আমরা জানি, যদি এই প্রবৃদ্ধির ফসল সবাই সমান বা সমানুপাতিক হারে ভাগ করে খেতে পারতাম তাহলে ‘দরিদ্র’ লোকের সংখ্যা অনেক অনেক কম হতো। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের সমস্যা আয় বণ্টনে। আমাদের সমস্যা বৈষম্যে। আরো কথা আছে। এই বৈষম্য দ্বারা সৃষ্ট ‘অতি দরিদ্র’ সমস্যা দূরীকরণে যখন আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করি তখন সেই সব পদক্ষেপকে অকার্যকর করে ফেলা হয়। আমি বলতে চাইছি আমাদের আয় বণ্টন সমস্যার কারণে প্রতি বছর সৃষ্টি হয় দরিদ্রের, অতি দরিদ্রের। অথচ তাদেরকে বাঁচানোর জন্য সরকার যখন উদ্যোগ নেয় তখন ‘চার্টার দল’ সব লুটোপুটে নেয়। এতে দারিদ্র্য স্থায়ীরূপ নেয়। এর একটা সাক্ষ্য দিচ্ছে বুধবারের দৈনিক ইত্তেফাকের একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘হতদরিদ্রের ভাগ্যে জুটছে না ১০ টাকা কেজির চাল’। শিরোনামের উপশিরোনাম: ‘হতদরিদ্রদের কান্না’। বলা হচ্ছে ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজন, ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতানেত্রীর পাশাপাশি সচ্ছল ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে গরিবের চালের কার্ড করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ওজনে কম দেওয়া, ১ মাসের চাল দিয়ে ২ মাসের স্বাক্ষর বা টিপসই নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে’। দৈনিক ইত্তেফাকের এই রিপোর্টটিতে বরিশালের বাবুগঞ্জ, মেহেরপুরের গাংনী, গোপালগঞ্জ, বরগুনা, ঝিনাইদহের মহেশপুর, বাগেরহাটের মংলা ইত্যাদি অঞ্চলের খবর আছে। শুধু এসব খবর নয়, বিগত বেশ কিছুদিন যাবত্ই বিভিন্ন কাগজে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খবরে আমরা দেখতে পাচ্ছি ১০ টাকা কেজি দরের চালকে নিয়ে দেশে এক হরিলুট চলছে।

 

অথচ সবাই জানি এই প্রকল্পের জন্মদাতা প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। এটা তার ‘ড্রিম প্রজেক্ট’। এবং প্রজেক্টটি সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের জন্য। অতিদরিদ্রদের জন্য। পঞ্চাশ লক্ষ পরিবার প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল পাবে। চালের দাম ১০ টাকা। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী ভারতে ৫০-৬০ কোটি লোককে এক টাকা ও দুই টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হয়। সেখানে আমাদের ক্ষেত্রে দশ টাকা দরে চাল। তাও হচ্ছে লুটপাট। সরকার এসব দমনে বহু পদক্ষেপ নিচ্ছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অথচ লোকগুলোকে বাঁচান দরকার। বাজারে মোটা চালের দর ৪০ টাকা কেজি। যে দিনাজপুর চালের জায়গা সেখানকার একটি স্টোরি পড়লাম, বীভত্স ঘটনা। মিলাররা দল বেঁধে চালের দাম বাড়িয়েছে। উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গা এক সময় মঙ্গাপীড়িত ছিল। সরকার নানাভাবে ঐ সমস্যার সমাধান করেছে। কিন্তু সে সব অঞ্চলেও চালের দাম উঁচুতে। একদিকে ১০ টাকা কেজি দরের চাল  মিলছে না, দরিদ্রদের, অতিদরিদ্রদের, অন্যদিকে খোলা বাজারে চালের দাম কেজিপতি ৪০ টাকা। ঢাকা শহরে সরকার ট্রাকে করে চাল বিক্রি করছে- কেজি প্রতি ১৫ টাকা। সরকারের গুদামে প্রচুর চাল। অনেক আটাও আমদানি করা হয়। এতদসত্ত্বেও বাজারে চালের দাম এত বেশি কেন- এর কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। মুশকিল হচ্ছে, অতিদরিদ্র লোকদের মধ্যে তো ৪০ টাকা কেজিতে চাল কেনা সম্ভব নয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই। ক্রয়ক্ষমতা থাকলে ৪০ টাকা কেন ১০০ টাকা কেজি হলেও ক্ষতি নেই। অথচ সেই ক্রয়ক্ষমতারই অভাব। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার এই ক্ষেত্রে কোনো কাজে লাগে না। কারণ সেটা গড়ের হিসাব। অধিকন্তু ‘জিডিপির’ লাভ পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলে। এক শতাংশ লোক পায় সেই লাভ।

 

সাত শতাংশের ওপরের হারের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির সুবিধাখাতে সবাই পায় তার ব্যবস্থা না করতে পারলে সমূহ বিপদ। আরো বিপদ মধ্যবিত্তের জন্য, নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য। তারা ১০ টাকা কেজি দরে চাল পাবে না। সরকারের কোনো ভাতা তারা পাবে না। অথচ তাদের সিংহভাগের রোজগার দিনদিনই কমছে। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে বড় বড় প্রকল্পে। সেখানে চাকরির সুযোগ কম। এসব ‘পুঁজি নির্ভর’ শিল্প। আবার লক্ষ লক্ষ মানুষের আয় কমছে। ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদের হার কমছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, শুধু চাল নয় সমস্ত জিনিসপত্রের দামই বাড়ছে। সয়াবিনের দাম মালিকরা বাড়িয়েছে। আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতারা বাড়িয়েছে। চিনির দর বেড়েছে। শাক-সবজির দর ভীষণভাবে বেড়েছে।  বলা হয়েছিল, বন্যার কারণে শাক-সবজির দর বেড়েছে। বন্যা গেছে কবে, শীত সমাগত, এখন নভেম্বর এসে গেছে। বাজারভর্তি শীতের সবজিতে। কিন্তু দর তো আকাশচুম্বী। দুই-একটা সবজির দর ৪০-৫০ টাকা কেজি। বাকি সব ৬০ টাকা  কেজি। মাছের সময় এখন। শীতকালেই মানুষ মাছ একটু সস্তায় পায়। এবার নিম্ন মূল্যের জন্য মানুষ ইলিশ খেতে পেরেছে। কিন্তু ইলিশ বাদে অন্যান্য মাছের দর এখন আকাশচুম্বী। যে পুঁটি মাছ ছিল গরীবের মাছ, কাচকি মাছ ছিল গরীরের মাছ; এসবের কেজিও তিনশত-চারশত টাকা কেজি। বেতন বৃদ্ধির বদলা ব্যবসায়ীরা নিচ্ছে। রিকশা ভাড়া বেড়েছে মারাত্মক হারে। স্কুল কলেজের বেতন, খাতা-কলমের দাম বেড়েছে। তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল মূল্যস্ফীতি সব খেয়ে ফেলছে। মধ্যবিত্তকে ধরেছে, নিম্নবিত্তকে ধরেছে। দরিদ্র ও অতি দরিদ্রকেও। মূল্যস্ফীতি জাপটে ধরেছে। এটা একটা অশনি সংকেত।

 

এতদিন একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। এখন কিন্তু উল্টো মনে হচ্ছে। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার উচ্চতর পর্যায়ে যাওয়ার পাশাপাশি। এমতাবস্থায় যদি ‘অর্থনীতি ওভারহিটেড’ হয় তাহলে মানুষকে বাঁচাবে কে? আমার মনে হয় এই বিষয়টির উপর এখন জোর দেওয়া দরকার বেশি। সমতার ওপর জোর দিলে, জিডিপির হার কম রেখেও অতিদরিদ্রের সমস্যা অধিকতর হ্রাস করা যায়। প্রবৃদ্ধির হার বেশি করলাম, পাশাপাশি নতুন দরিদ্র ও অতিদরিদ্র সৃষ্টি করলাম বৈষম্যের মাধ্যমে, মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে তাহলে তো তা কোনো কাজের কথা হলো না। আশা করি উন্নয়নের এই সমস্যাটার প্রতি নজর দেওয়া হবে। কোনটা ভাল-বৈষম্যহীন ৭ শতাংশ উন্নয়নের মাধ্যমে দরিদ্রশূন্য বাংলাদেশ, না বৈষম্যপূর্ণ ৮ শতাংশ উন্নয়নের মাধ্যমে দরিদ্র ভরপুর বাংলাদেশ?

 

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়