আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রবেশ করলাম তখন সেখানে অবস্থান করছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, নৌবাহিনীর প্রধান ও র্যাবের ডিজি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন কবিকে অপেক্ষায় রাখলেন না। তিনি প্রথমেই কথা বললেন আমার সঙ্গে। প্রায় ৪৫ মিনিট আমার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকে ক্রিকেট নানা বিষয়ে কথা বললেন। এটাই শেখ হাসিনা। তার ভিতরে কোথায় যেন একটা মাতৃস্নেহ কাজ করে। গতকাল প্রেসক্লাবে এভাবেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজের আলাপচারিতার বর্ণনা দিলেন কবি হেলাল হাফিজ।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা আমার এক বছরের সিনিয়র। আমরা তাকে হলিউডের তৎকালীন নায়িকা গ্রেটা গার্বো বলে ডাকতাম। আমি এ কথা তাকে বলেছি। তিনি হেসেছেন। আমার দুটি কবিতা আমি প্রধানমন্ত্রীকে শুনিয়েছি। তিনি গভীর মনযোগ দিয়ে শুনেছেন। ক্রিকেট নিয়ে আমি বলেছি, টেস্টে আমাদের ছেলেদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে বলেছেন, তোমার কথা ঠিক না। ওদেরও দক্ষতার অভাব আছে। আমাদের ছেলেরা জিতে গেছে।
গত সপ্তাহে কবি হেলাল হাফিজ চোখ দেখাতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি অপেক্ষা করছি প্রেসক্লাবে। ফিরে এলেন দুপুরের কিছু আগে। বললাম কি বললো ডাক্তার। তিনি চোখ প্রসঙ্গের আগেই বললেন, দেখ ডাক্তার আমাকে কত ভালবাসে। কোন ডাক্তার। বললেন, ডা. নূসরাত চৌধুরী। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কত কথা হলো। তবে সেও একমত চোখটি আর ভালো হবে না। তবে তারা একটা ঠিকানা দিয়ে বলল, হায়দ্রাবাদে একজন চিকিৎসক আছেন, তিনি এ বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত। যদি কিছুটা ভালো হয়। ডাক্তার বলেছেন, ভালো চিকিৎসা পেলে ২৫ শতাংশ দৃষ্টি হয়তো আমি আমার চোখে ফিরে পাব। আমি ভাবছি একবার হায়দ্রাবাদ যাব। অর্থ সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাকে বললেন, দেখতো দুজন মানুষের বিমান ভাড়া কত। ওখানে অন্তত ৭ দিন থাকা-খাওয়ার খরচ কত। আমি বললাম হিসাব করে জানাব।
গত রোববার দেখলাম নূসরাত চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে গেছেন কবিকে। ওনি ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লিখেছেন, কবির চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলকে ফোন করি। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কবিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান। সকালে স্ট্যাটাসে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কবির চিকিৎসার ভার নিয়েছেন। ডা. নূসরাত চৌধুরী ও শাকিল ভাইকে ধন্যবাদ। কবি হেলাল হাফিজ তার চোখের চিকিৎসা করাতে পারবেন। তিনি আর অন্ধ হবেন না। আনন্দে মনটা ভরে উঠছে। চোখের জন্য অল্প অল্প করে তিনি কিছু অর্থ সঞ্চয় করছিলেন। বলছিলেন, অর্থতো কখনো সঞ্চয় করিনি। অর্থ আর খ্যাতি দুটাই ভয়াবহ। এগুলোতে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। সারাজীবন এ দুটির সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। জীবনটা বন্দি হয়ে যায়। অনেককে দেখেছি বের হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। পারে কই। ’৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র চলে গিয়েছিলাম। ৬ মাস ছিলাম। মন হাফিয়ে উঠেছে। অর্থের জন্য কত পরিশ্রম করছে মানুষ। আমাকেও ওখানকার লোক বললো আপনার একলা জীবন এখানেই থেকে যান। অর্থের সমস্যা হবে না। থাকতে পারলাম না।
আমাকে ভালবাসাই সারাজীবন টেনেছে। ভালবেসে আমাকে যে যাই দেয় আমি নেই। ভালবাসার দানতো ফেরানো যায় না। এইতো কিছুদিন আগে একজন কানাডা থেকে ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি তাকে চিনিও না। সে শুধু জানিয়েছে, আমি আপনার কবিতা থেকে ভালবাসা পেয়েছি। তার দক্ষিণা আপনাকে দিলাম। ভালবেসে। একজন রিকসাওয়ালা ভাড়া নেয়নি। বলেছে আপনাকে ভালবাসি। কীভাবে ফেরাবো বলো এতো ভালবাসা। জীবনকে তো কতভাবেই দেখা যায়। ধর বাংলাদেশের কত কোটি কোটি মানুষ কত রকম যন্ত্রণায় রয়েছে। আমার তো চোখের যন্ত্রণা। তার জন্য হাত পাতবো কেন। দরখাস্ত করব কেন। অনেকেই বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত করুন উনি ব্যবস্থা করবেন। আমি বলেছি এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাতে আমার কবি সত্ত্বা বিপন্ন বোধ করবে। তার চেয়ে আমি অন্ধ হয়ে যাব।