আড়ালে রাখলে যেভাবে সর্বস্ব দিয়ে কোনো চারাগাছ আলোর খোঁজে মাথা তুলে থাকে, একটু যত্নের ছোঁয়ায় সেটিই পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে মহীরুহ। ১৪ মাসের অবহেলিত থাকার পর এবার যখন বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেল, তখন মেহেদি-সাকিবদের হাতের স্পর্শে তাতেও যেন ফিরে এলো প্রাণ। চট্টগ্রামে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ঢাকায় ইংল্যান্ডকে ১০৮ রানে পর্যুদস্ত করে ক্রিকেটের বিশুদ্ধ এই ফরম্যাটে এক নবযাত্রা শুরু করল বাংলাদেশ। ওয়ানডের আর টি২০-এর রমরমা বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে এই টেস্টের অমৃত সুধা যেন আবার হারিয়ে না যায়, ভয়-শঙ্কা আগামীর দিনগুলো নিয়েই। বস্তুত ক্রিকেটবিশ্বের রাজসিক ব্রিটেনকে হারিয়ে ধ্রুপদ ক্রিকেটে শুরু হলো বাংলাদেশের নবযাত্রা।
ঢাকা টেস্ট জয় যে সিঁড়ি দেখিয়েছে বেড়ে ওঠার, মেহেদি-সাকিবদের তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে যে স্বপ্ন ধরা দিয়েছে, তা মিথ্যা হতে দেবেন না বাংলাদেশের লংকান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, ‘আমি যখন প্রথম দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসি, তখন কিছুদিন শুধু পর্যবেক্ষণ করেছি তাদের। আমার মনে হয়েছে, প্রতিভার অভাব নেই, একটু আত্মবিশ্বাস পেলে তারা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পারবে। ছেলেদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাসটাই আমি দিতে চেষ্টা করেছি শুধু। ওয়ানডের পর টেস্টেও একটু একটু করে উন্নতি দেখছি এখন। তবে এতে আত্মতৃপ্তির বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। পথ দীর্ঘ এবং বন্ধুর। আমাদের টেস্ট দলের সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। এখন আমরা ঘরের মাঠে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় এগোচ্ছি।
পরবর্তী সময়ে বিদেশে গিয়েও ভালো খেলার ছক তৈরি করতে হবে।’ টাইগারদের টেস্ট-পরবর্তী মিশন নিউজিল্যান্ড সফর। ঘরের মাঠে চার স্পিনার দিয়ে বাজিমাত করালেও নিউজিল্যান্ডের ঘাসের পিচে খেলতে হবে। সেখানে যে পেসারদেরই তেড়েফুঁড়ে বোলিং করতে হবে। আমাদের তো পেসারের দুর্ভিক্ষ। এ মুহূর্তে মুশফিকদের হাতে টেস্ট পেসার আছে কি? কাটার মাস্টার মুস্তাফিজকে খেলার জন্য বিবেচনা করা হবে না- এমন একটা ইঙ্গিত বিসিবি থেকেই দেওয়া হয়েছে। তাসকিনকেও এ মুহূর্তে লাল বলে আনবেন না- কোচ নিজেই জানিয়েছেন। যে পেসারদের নিয়ে গত দু’বছর কাজ করা হয়েছে, সেই আল-আমিন আর রুবেল হোসেনেরও নাকি ফর্ম খারাপ। তাহলে টেস্ট পেসার আছে কে? ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্ট খেলা পেসার কামরুল ইসলাম রাবি্বর যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে, তা বলাই বাহুল্য। পেসার শুভাশীষ আর শফিউলকে পছন্দ বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের। কিন্তু তারও মৃদু অভিযোগ আছে, ‘আমার বয়স যখন ওদের মতো, তখন নিজে নেটে প্রতিদিন টানা দুই ঘণ্টা বোলিং করেছি। ঘরোয়া লীগে এমনও হয়েছে যে একটানা ৪০ ওভার পর্যন্ত বোলিং করেছি। সেখানে এখনকার পেসাররা ওই খাটুনিটাই নিতে পারে না।’ মিরপুরে একদিন গল্পচ্ছলে এভাবেই দুঃখ প্রকাশ করছিলেন ওয়ালশ।
পেসারদের এই অনাগ্রহের জন্য তাদের দায়ী করাটাও বা কতটা যৌক্তিক? প্রশ্ন রেখেছেন সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, ‘ইংল্যান্ডের এই সিরিজের পর আমাদের মানতেই হবে যে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে নতুন এক যুগ শুরু হতে চলেছে। তবে এটা ধরতে রাখতে হলে আমাদের আগামীতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আমার মনে হয়, প্রতিটি সিরিজের আগে আমাদের প্রস্তুতিতে কিছুটা ঘাটতি থেকে যায়। এই যেমন নিউজিল্যান্ড সফরের আগে আমরা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ায়। নিউজিল্যান্ড কেন নয়? কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোচের পরামর্শকে বিসিবি খুব বেশি ফলো করছে। এ ব্যাপারে বিসিবিরও কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। দ্বিতীয়ত, আমাদের বয়সভিত্তিক দল কিংবা একাডেমির মতো দলগুলোকে আরও বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিতে হবে বিসিবির। একটু খেয়াল করলে আমরা দেখব, গত দুই বছরে জাতীয় দলে সাত থেকে আট ক্রিকেটার এসেছে বয়সভিত্তিক দল থেকে। আমাদের এই পাইপলাইনটা শক্ত রাখতেই হবে। আজ যে মিরাজ কিংবা মুস্তাফিজ, তারা কিন্তু ওই পাইপলাইন থেকেই এসেছে। সে সঙ্গে সৌম্যর মতো ক্রিকেটারদের ফর্মে ফেরানোর দায়িত্বও নিতে হবে কোচকে। একই সঙ্গে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম শ্রেণিতে পেস-সহায়ক কিছু উইকেটও রাখতে হবে। তাহলেই ম্যাচগুলোতে পেসারদের ব্যবহার করবে অধিনায়করা।’
২০০০ সালে যখন বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পায়, তখন দেশে প্রথম শ্রেণির কোনো টুর্নামেন্ট ছিল না। লঙ্গার ভার্সনে কিছুটা আনকোরা থেকেই টেস্টের যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। আর সে কারণেই প্রথম টেস্ট জয় পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। ঢাকা টেস্টের আগে ৯৪ টেস্টের মধ্যে মাত্র সাতটিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। লঙ্গার ভার্সনে বাংলাদেশিদের এই পারফরম্যান্সের কারণেই আইসিসির সভায় ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দলগুলো বলতে পারে- আমাদের এখানে আসার দরকার নেই, আমরা বরং তোমাদের ওখানে গিয়ে খেলে আসব। কিন্তু ঢাকা টেস্টে ইংল্যান্ডের পরিণতি দেখে এখন নিশ্চয়ই বিশ্বক্রিকেটের মোড়লরা নড়েচড়ে বসবে। ‘এই টেস্ট জয় যে আমাদের অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেল। এখন অনেক দলই আমাদের আমন্ত্রণ জানাবে, আমাদের এখানে এসেও খেলতে চাইবে।’ বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুজন জানাচ্ছিলেন, এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়াও আগামী বছর আসার আগ্রহ দেখিয়েছে। আসলে আইসিসি নতুন নিয়ম করে দেওয়ায় এখন দুটি বোর্ড নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে টেস্টের সূচি ঠিক করে। সেখানে ইংল্যান্ড গত বছর আলোচনায় বসে তাদের ওখানে বাংলাদেশকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি। তবে ঢাকা টেস্টের পর চিত্রটা নিশ্চয়ই বদলে যাবে- এমনটাই আশা বিসিবির প্রধান নির্বাহীর।
এক দশক ধরে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলছেন মুশফিক। বহু চড়াই-উতরাই দেখেছেন তিনি ড্রেসিংরুমে থেকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এবারে একটি ছক কষেছিলেন তিনি, ‘আমি দেখেছি, উপমহাদেশের প্রতিটি দলই হোম অ্যাডভান্টেজ নিয়ে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোকে মোকাবেলা করে। সেখানে আমরা কেন নয়, সে চিন্তা থেকেই স্পিননির্ভর অ্যাটাক সাজিয়েছিলাম আমরা। তবে এখনও অনেক কিছু বাকি আমাদের…।’ মুশফিক ইঙ্গিত করছিলেন, টেস্ট উপযুক্ত পেসার, যারা কি-না নতুন বলে সুইং আর পুরনো বলে রিভার্স সুইং করাতে পারে। একজন লেগস্পিনারের অভাববোধও করেছেন মুশফিক। সবেধন নীলমণি এক লেগস্পিনার অবশ্য আছে হাথুরুর ক্যাম্পে। সেই জুবায়ের হোসেন লিখনের পারফরম্যান্সে মোটেই খুশি নয় টিম ম্যানেজমেন্ট। শেষ বেলায় সাবি্বরকে দিয়ে পার্টটাইম লেগস্পিনটা করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন মুশফিক। দেশে পেসার হান্ট থাকলেও এ ধরনের লেগস্পিনার হান্টের কোনো উদ্যোগ নেই। সেটাতেই আরেকটু মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, ‘একটি আদর্শ টেস্ট দলের বোলিংয়ে সব ধরনের অস্ত্র মজুদ থাকা উচিত। এ মুহূর্তে আমাদের অফস্পিনাররা ভালো করছে; কিন্তু কোনো লেগস্পিনার নেই। বিসিবির উদ্যোগে লেগস্পিনার হান্ট হতেই পারে।’
ঢাকা টেস্টের পর তামিম বলেছেন, তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিরিজ ছিল এটি। শুধু জয়ের কারণেই নয়, কঠিন উইকেটে রান করতে পারার আত্মতৃপ্তি ছিল তার মধ্যে। সে হিসেবে অধিনায়ক মুশফিক কিন্তু দুই টেস্টের কোনোটিতেই সেভাবে রান করতে পারেননি। চার ইনিংসে তার মোট রান ১০০। দল যখন বিপদের মুখে, তখন মুশফিক অধিনায়কসুলভ বীরত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। ঢাকা টেস্টের কিছু সেশনে তার রক্ষণাত্মক কৌশলও সমালোচিত হয়েছে, ‘টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে মুশফিক বেশ ভালোই করছেন। তবে কিছু কিছু জায়গায় তিনি আরও ভালো করতে পারেন। এই যেমন, ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের নবম উইকেটে জুটি ভাঙার সময় তিনি আরও আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজাতে পারতেন। তবে বেশি বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পেলে এসব আরও নিখুঁত হয়ে যাবে।’
টেস্ট চর্চার জন্য দেশে এখন লঙ্গার ভার্সনের দুটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট হয়ে থাকে- বিসিএল ও এনসিএল। কিন্তু এ দুটি টুর্নামেন্টের মান কতটা উন্নত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তামিমই আক্ষেপ করছিলেন, ঘরোয়া লীগে আমরা কখনও স্টোকসের মতো রিভার্স সুইং ফেস করি না। না নেটে, না ম্যাচে- কোথাও ওই ধরনের বোলিং খেলি না আমরা। সেখানে টেস্টে এসেই ওই ধরনের বল মোকাবেলা করা নতুন কারও জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের। আর এখানেই ঘরোয়া লীগে পেস-সহায়ক কিছু উইকেট তৈরির তাগাদা দিয়েছেন তামিম ইকবাল।
টেস্টের এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে অগোচরে চলা আরও একটি টুর্নামেন্টকেও ফোকাসে আনতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে অনেকটা নীরবেই খেলা হয় অনূর্ধ্ব-১৬ দু’দিনের ম্যাচ। এ ধরনের টুর্নামেন্টেই প্রথম লাল বলে হাতেখড়ি হয় ক্রিকেটারদের। উপজেলা থেকে জেলা, সেখান থেকে বিভাগ করে প্রতিভাবানদের ঠাঁই হয় বিসিবির একাডেমি ভবনে। তবে অনেকেই এর মাঝে লাল বলের মায়া ছেড়ে সাড়া দেন বিপিএলের মতো লোভনীয় ক্রিকেটের হাতছানিতে। মারকাটারি ওই ফরম্যাটেই অনেকে খুঁজে পান প্রতিষ্ঠিত ভবিষ্যৎ। তাই টেস্ট থেকে যায় অবহেলাতেই। ওয়ানডের অনেক প্রতিষ্ঠিত বোলারও তাই খেলতে চান না টেস্ট। তাই কিশোর ক্রিকেটারদেরই লাল বল, সাদা পোশাক আর টেস্টের স্বাদ দিতে হবে।