আয়কর মাস ও সপ্তাহ পালন প্রাক্কালে এটা জানা বেশ প্রশান্তি প্রদায়ক যে বাংলাদেশের অন্যান্য খাতের বা ক্ষেত্রের চেয়ে রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে উৎসাহব্যঞ্জকভাবেই। আনন্দদায়ক যে আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ সাফল্য আসছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টনব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতা সঞ্জাত মনোভঙ্গি ভজনের, পদ্ধতি সহজীকরণের, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। গত পাঁচ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকায় এসেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা আর ২০১১-১২ অর্থবছরে তা ৩৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে অধিক পরিমাণে শুল্ক ও কর রাজস্ব আহরণের একটি অবারিত সুযোগ ও সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, এ পাঁচ অর্থবছরে কম্পানি ও কম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯ঃ৪১ থেকে ৫৫ঃ৪৫-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে এবং সার্বিক কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২৫ থেকে ৩৪-এর মধ্যে রয়েছে। তবে বলে রাখা ভালো, এখনো আয়কর কর রাজস্বপ্রাপ্তির পরিবারে তৃতীয় শরিক, অর্থনীতির আকার-অবয়ব, চেহারা ও চরিত্র অনুযায়ী আমদানি শুল্ক (আশু) ও মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) টপকে আয়করের অবস্থান এক নম্বর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি? সার্বিক রাজস্ব আয়ে অধিক পরিমাণে মূসক হিস্যা এখনো ৩৩-৩৪ আর আশু ৩০ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে আয়করের অবদানকে অগ্রগামী গণ্য হতে হলে আরো জোরে চালাতে হবে পা, হতে হবে আরো গতিশীল, চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ।
দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েকটি বছরের আগ পর্যন্ত আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রাও ছিল অত্যন্ত ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী এর মধ্যেই প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রমেই কম্পানি ও কম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০ঃ৩০ থেকে ৫৮ঃ৪২-এ পৌঁছেছে। দেশে করপোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে কম্পানি ব্যতীত করদাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পার্সন, আর্টিফিশিয়াল জুরিসডিক্যাল পার্সনস রয়েছেন—তাঁদের কর নেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরো জোরদারকরণের অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএনধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতে যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চলছে। যাঁরা আয়কর নথি খুলেছেন, তাঁদের মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশিক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি, তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি-প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতাবান্ধব বা সহজ করা যাবে তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে কর নেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। দেশের কর জিডিপি রেশিও উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য যে সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকেই মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।
মোট কর রাজস্বে আমদানি শুল্কের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৪২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ২৭ শতাংশ, ০৫ শতাংশ, ০৯ শতাংশ, ২২ শতাংশ ও ১১ শতাংশ—অর্থাৎ বড় এলোমেলো ও অপরিকল্পিত প্রয়াস পরিস্থিতি নির্দেশ করে। ডাব্লিউটিওর অনুশাসন মেনে শুল্কায়নপ্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক হ্রাস পেতে থাকবে—এমন একটা ধারণা বা যুক্তি বিদ্যমান থাকলেও ক্রমান্বয়ে উচ্চ শুল্কায়নযোগ্য সামগ্রীর আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে শুল্ক আয় সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির কার্যকারণ সম্পর্কটিও পরীক্ষা-পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। মূল্য ওঠানামার সঙ্গে ট্যারিফ স্ট্রাকচারের সমন্বয় সাধন, ভ্যালুয়েশনসহ শুল্কায়নে অধিকতর একাগ্রতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও প্রকৃষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য থেকে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর আয়ের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৩৩ শতাংশ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয়কর আয়ের সামঞ্জস্যহীন পরিস্থিতি নির্দেশ করে। মূসক আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মিশ্র হারও যথাক্রমে ২৩ শতাংশ, ১৩ শতাংশ, ২৫ শতাংশ, ২৯ শতাংশ ও ২৩ শতাংশ, যা মূসক আয়ের টেকসই ও ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ করে না। এ সময়ের (২০০৬-১২) গড় প্রবৃদ্ধি আমদানি (২২ শতাংশ), জিডিপি (৫-৭ শতাংশ) ও মূল্যস্ফীতির (৭-৯ শতাংশ) হিসাব ও স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনলে স্থানীয় পর্যায়ে পরোক্ষ কর থেকে আয়ের প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম ২৫ শতাংশের বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়। মোট কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ২৫ শতাংশ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সময়গুলোর তুলনায় বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি। এ ধারা আরো বেগবান হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে আয়করের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশ, ১১ শতাংশ, ১৮ শতাংশ, ২৮ শতাংশ ও ১৯ শতাংশ—অর্থাৎ সুস্থিরভাবে ঊর্ধ্বগামী হতে পারেনি। আয়করদাতার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত, তা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। লোকবলের সমাহার ঘটিয়ে সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে পারলে মোট রাজস্বে আয়কর খাতের হিস্যা বাড়ানো সহজতর হবে। কর জিডিপি রেশিও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে তাই প্রয়োজন সবার সমন্বিত প্রয়াস।
নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পুরনো উদ্যোগের সালতামামি বা ফলোআপ আবশ্যক হবে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে জমকালো জরিপের মাধ্যমে যে লক্ষাধিক করদাতা শামিল হয়েছিলেন করদাতার মিছিলে, তাঁরা কি আছেন? ২০০৭-০৮ কিংবা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করদাতা হয়েছিলেন, তাঁদের খবর কী? দেশে যে প্রায় ছয় লক্ষাধিক ক্রেডিট কার্ডধারী আছেন, আছেন প্রায় সমসংখ্যক গাড়ি-বাড়ির মালিক, তাঁদের কাছে যাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা কী? ভুয়া টিআইএন ব্যবহারকারীদের সঠিক পথে আনার প্রতিবন্ধকতাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সময় ফুরিয়ে যায়নি। আয়করদাতা যাতে নিজেই রিটার্ন ফরম পূরণ করতে পারেন সে ব্যাপারে যে সহায়ক নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছিল, প্রচারিত হয়েছিল সিটিজেন চার্টার, তা কি গণ-অবহিতির অবয়বে আছে এখনো? আগেও যেসব কর তথ্যকেন্দ্র, সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল প্রকল্পের প্রেরণায় সেগুলোর কার্যকারিতা থেমে গেছে কি না তা দেখার অবকাশ রয়েছে। একই কার্যক্রম বারবার ‘নতুন’ করে চালু করলে ভিন্ন বার্তা পৌঁছতে পারে টার্গেট গ্রুপের কাছে। কর মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করে করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেওয়াকে দায়িত্ব মনে করছেন, তাঁদের এই আগ্রহ ধরে রাখতে হবে, তাঁদের উদ্বোধিত দায়িত্ববোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তাঁদের আগ্রহকে সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচার-প্রচারণার কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না, কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অতীতে বর্তমানের মতো প্রযত্ন প্রদানের নজির ছিল না, এখন এসব সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে সেই ১৯৯০ সাল থেকে এযাবৎ সাত-আটটি প্রকল্প (বিদেশি সাহায্যপুষ্ট, বিদেশি বিশেষজ্ঞের ভারে ন্যুব্জ) বাস্তবায়ন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু অটোমেশন, অনলাইনিং, সিট্রমলাইনিং, স্ট্রেংদেনিংয়ের জন্য। ২০ বছরে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারা অর্জিত অগ্রগতি দৃশ্যগোচর না হোক, অন্তত অনুভব সম্ভব হবে যদি দেখা যায় সবার মাইন্ডসেট ও কর্মকুশলতায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে।
তবে এটাও ঠিক বর্তমানে যে অব্যাহত অগ্রগতি তার পেছনে সেসব প্রয়াসের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি ও তা নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে যে কাজ করছে তা অনস্বীকার্য। একই সঙ্গে সম্মানিত করদাতাদের সার্বিক সহযোগিতা, তাদের অভূতপূর্ব দায়িত্ববোধের উদ্বোধন, জটিল কর আইনগুলো সহজীকরণের প্রতি তাদের আকিঞ্চন প্রত্যাশাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।