এটি এখন বাংলাদেশ সরকার ও দেশের বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রধান লক্ষ্য ও অঙ্গীকার যে, ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন ও ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার সময়কালে যা এই দেশটির স্বাধীনতারও ৫০ বছর পূর্ণ হবে তখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে পেঁৗছাবে। গত ২১ অক্টোবর সমাপ্ত হওয়া ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডেও এই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। দেশের মিডিয়া থেকে নীতি নির্ধারকদের মাঝে প্রসঙ্গটি কেবল কৌতূহলোদ্দীপক নয়, বরং চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। বিশেষত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আমাদের ২০১৫-১৬ সালের রপ্তানি আয় মাত্র ১৫১.৯ মিলিয়ন ডলার বলে গণ্য করে তখন আমাদের জন্য ১ বিলিয়নই হোক বা ৫ বিলিয়নই হোক সেটি অর্জন করা যে প্রায় অসম্ভব তেমনটিই ধারণা করা হয়। চারপাশ থেকেই এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে আমরা যেন কোনভাবেই ১ বিলিয়ন বা ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারবো না। কিন্তু ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলককে যে তারা উভয়েই আমাদের শিল্প খাতের মতোই বিশ্বাস করেন যে, এমন একটি স্বপ্ন আমাদের বেসরকারি খাত অর্জন করতে সক্ষম। আমি এই খাতের বৃহত্তম বাণিজ্য সংগঠন বেসিসের সভাপতি হিসেবে বলতে পারি যে আমাদের হিসাবটা ৫ বিলিয়ন-এর নয়, বরং ৫০ বিলিয়নের। হিসাবটি আমার এই নিবন্ধ থেকে বুঝে নিতে পারেন।কেন বা কেমন করে আমরা এই সফলতা অর্জন করতে পারবো সেগুলো আমরা একটু তলিয়ে দেখতে পারি। অন্যদিকে এটিও আমাদের দেখা দরকার যে এই অর্জনের জন্য সরকারের ও এই খাতের কোন কোন করণীয় রয়েছে।প্রথমেই নজর দেয়া যাক দুনিয়ার আউটসোর্সিং বাজারটি কতবড় তার দিকে। আমরা জেনেছি যে, ২০১৫ সালে বিশ্বজুড়ে আউটসোর্সিং বাজারের মূল্য ছিল ৮৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৭ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার। তবে লক্ষণীয় যে বিগত সময়ে এই বাজারের প্রবৃদ্ধি তেমন নয়। ২০১০ সাল থেকে যে চিত্রটি আমাদের সামনে আসে তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। বিশ্ববাজারে আউটসোর্সিং আয় হিসাবটি আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার অথোরিটি এঙ্লিারেন্স থেকে পাওয়া। ওয়েবসাইট লিংকঃ: http://www.accelerance.com/research/global-it-market-size-facts-and-figures বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং বাজারের বিকাশের জন্য ভিত্তিগত পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। দেশের আউটসোর্সিং শিল্প ক্রমেই আরো পরিপক্ক হয়ে উঠছে, একই সাথে অনেকে দেশের বাইরে আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন। ভৌগোলিকগত দিক থেকে ৯০ শতাংশের বেশি আইটি খাতে ব্যয় হয় উত্তর আমেরিকা (৩৯৩৩), পশ্চিম ইউরোপ (৩১৭৪) এবং এশিয়া প্যাসিফিক (১৯১৪) অঞ্চলে।বর্তমানে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং সেবার একটি বড় অংশ যায় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়া। এদেশের উদীয়মান রপ্তানিকারকরা তাদের যোগ্যতার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছে। বাংলাদেশ সুলভ মানবসম্পদসহ আরও অনেক দিক দিয়েই ভারত এবং ফিলিপাইন থেকে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশকে আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা হয়। গার্টনার বাংলাদেশকে আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ ৩০টি দেশের মধ্যে স্থান দিয়েছে। এটি কারনির সার্ভিস ইন্ডেঙ্ওে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ৪ ধাপ এগিয়েছে।রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি নিম্নরূপ:আমরা যদি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যাদিকে বিশ্লেষণ করি তবে আমাদের দেশের রপ্তানির চিত্রটিও বিচিত্র। আমাদের প্রবৃদ্ধির হিসাবটিও সরল রেখায় ওঠানামা করছে না। কখনও সেটি ৫৬.২৮ ভাগ বেড়েছে। আবার কখনও সেটি মাত্র ৪.৭১ ভাগ বেড়েছে।বিশ্বে আউটসোর্সিং বাজারের আকার নিয়ে গবেষণায় জানা গেছে যে গত ৩ বছরে দেশগুলোর আইটিতে ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি অস্থিতিশীল। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আউটসোর্সিং-এ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর। এ থেকে বোঝা যায় আমাদের দেশিয় আউটসোর্সিং সেবার চাহিদা বহির্বিশ্বে বেশ ভালোভাবেই আছে। প্রসঙ্গত এটি উল্লেখ করা দরকার যে ভারত ২০১৫ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এখন ৯৯ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। ১৬ সালে ১১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির আশা করে। তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে ১৫ সালে ১৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে যার বৃহত্তম অংশ ই-কমার্সের। আমরা ভিয়েতনামের হিসাবটা পেয়েছি ১৫ সালে তারা ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে।ইপিবির হিসাবের (১৫১.৮ মিলিয়ন ডলার) পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সূত্র মতে, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)তে গত বছরে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সার আয়ের সঠিক হিসাব না থাকলেও তাদের আয় কমবেশি ১০০ মিলিয়ন ডলার বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল গেইমিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে আমাদের আইটি সেক্টর, ফ্রিল্যান্সিং_ সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে বলে সরকারিভাবে বলা হয়েছে।ব্যক্তি পর্যায়ে প্রযুক্তি সেবায় বিপুল পরিমাণ আয় হলেও তা ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আসছে না। আমরা রপ্তানি আয়ের বিচিত্র একটি ধারণা পাই যদি বেসিস সদস্যদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করি। বর্তমানে বেসিস সদস্যভুক্ত আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬। এদের মধ্য থেকে ৩৮২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা গত বছর ৫৯৪.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানি করেছে। বেসিস সদস্যভুক্ত নয় দেশে এমন আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্তত আরও ১০০০। এই হিসাব থেকে সমগ্র খাত সম্পর্কে একটি আন্দাজ করা যায়।২০১৫ সালে দেশের আইটি রপ্তানির আনুমানিক চিত্র:৩৮২টি বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় ৫৯৪.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৯৫৬টি সদস্য প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় (আনুমানিক) ১৪৮৮.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারবেসিস সদস্যভুক্ত নয় এমন ১০০০টি আইটি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় (আনুমানিক) ১৫৫৬.৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারমোট রপ্তানি (আনুমানিক) ৩০৪৫.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারতবে এটি সত্য যে আইটি খাতের সকল প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করে না। সে ক্ষেত্রে যদি ধরা হয় তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ রপ্তানি কাজে জড়িত, তবুও এর পরিমাণ প্রায় ৭৬১.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে।আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে এটি উল্লেখ করতে চাই যে, গত ১৯-২১ অক্টাবর ১৬ ঢাকার বসুন্ধরা কনভেনশন সিটিতে আয়োজিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-এর মাঝে ১৯ অক্টোবর বিকাল তিনটায় সম্পন্ন মিনিস্টারিয়াল কনফারেন্সের মূল প্রবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের রপ্তানি এখন ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এতে বোঝা যায় যে বেসিসের হিসাবটির সত্যতা সরকারিভাবেও রয়েছে।যাহোক এসব আনুমানিক হিসাব শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক জরিপ দিয়েই নিশ্চিত করা যাবে। বেসিস বা সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের জরিপ অগ্রাধিকার পেতে পারে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের নির্বাহী পরিচালকের কাছ থেকে জেনেছি যে, ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে সফটওয়্যার ও সেবা খাতের আয়কে রিপোর্ট করে না বলে তাদের হিসাবকেও তারা সঠিক বলতে পারেন না। আমি নিজে বাংলাদেশের একটি বড় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের খবর জানি যারা ১২.৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশে আয় করে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান ৫৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে কিন্তু সেটি আমাদের ব্যাঙ্কের রপ্তানি হিসেবে আসেনি। কিন্তু তাদের একটি ডলারও তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি হিসেবে রিপোর্ট করা হয় না। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের হিসাব এভাবে করে তার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না এই বিষয়ে আমদের কোন সন্দেহ নেই। তবে হিসাবের চাইতেও অনেক বড় প্রসঙ্গ হচ্ছে করণীয় নিয়ে। প্রথমত বেসরকারি খাতের কথাই আগে বলা যায়। আমি মনে করি আমরা বিগত সময়ে পুরো বিষয়টিকে বাস্তবানুগভাবে না দেখে অনেকটা অন্যের দেখানো পথে হেঁটেছি এবং যুক্তির চাইতে আবেগের দিকে বেশি নজর দিয়েছি। আমি এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের উদাসীন্যের কথা বলতে পারি। অতীতে আমরা বছরের পর বছর রপ্তানি বলে চিৎকার করলেও একবারও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের কথা বলিনি। এর ফলে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়লেও দেশের ভেতরের বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ কমেছে।এক. অভ্যন্তরীণ বাজার: অনেকের কাছে এটি মনে হতে পারে যে রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আমরা দেশের ভেতরের বাজারের কথা বলছি কেন? বাস্তবতা হলো রপ্তানি বাজারে প্রবেশের জন্য আমার নিজের দেশের বাজারে কাজ করার অভিজ্ঞতা বা সফলতার ভিতটা তৈরি করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যের লোকজন পারতপক্ষে দেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করেন না। ১ কোটি টাকার কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার তারা ১০০ কোটি টাকা দিয়ে কেনেন, প্রতিদিন বিমানে করে বিদেশি আনেন, পাঁচ তারা হেটেলে তাদের রাখেন, কিন্তু আমার নিজের দেশের মানুষকে কাজ করতে দেন না। সরকারি কাজে এমন সব শর্তজুড়ে দেয়া হয় যার জন্য আমাদের দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডারেই অংশ নিতে পারে না। দেশি সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও টার্ন-অভারের শর্ত পূরণ করা যায় না। অন্যদিকে হার্ডওয়্যার রপ্তানির জন্য বিদেশি প্রখ্যাত ব্রান্ড-এর কথা বলেই দেয়া হয়। আমি মনে করি হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের দেশি বাজার গড়ে তুলতে হবে।ফলে আমি সরকারের সকল কাজ দেশি হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সেবা গ্রহণ করার ও আমাদের সন্তানদের দিয়েই সৃজনশীল কাজ করানোর অনুরোধ করি। এটির একটি বাড়তি সুবিধা হচ্ছে যে এর ফলে আমাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।আপনি কি ভাবছেন কেবল অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করলেই আমরা ৫ বিলিয়নের বদলে ৫০ বিলিয়ন রপ্তানি করতে পারব? সামনে আমরা সেটিও ব্যাখ্যা করব।ঢাকা, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬।[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]mustafajabbar@gmail.com