কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে রোডম্যাপ

দেশে চাষ যোগ্য কৃষি জমি কমছে ক্রমাগত। স্বচ্ছল জীবনের আশায় কৃষি শ্রমিকরা পাড়ি জমাচ্ছেন গ্রাম ছেড়ে শহরে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়ে চলেছে ফসলের চাহিদা। এই প্রেক্ষাপটে কম জমি কম শ্রমিক দিয়ে অধিক ফসল উত্পাদনের লক্ষ্যে রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে সরকারের কৃষি বিভাগ। তারা চাচ্ছে, কৃষি ব্যবস্থাপনা যান্ত্রিকীকরণের মধ্যদিয়ে ফসলে বিপ্লব ঘটাতে, বপন-রোপণ প্রক্রিয়া হতে ফসল কর্তনসহ সর্বব্যাপী যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে। কেবল জমি চাষই নয়, জমিতে নিড়ানি, সার প্রয়োগ, কীটনাশক ছিটানো, ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও ধান থেকে চাল করা- সবই হবে যন্ত্র নির্ভর।

 

কার্যত কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ হয়ে উঠেছে অনিবার্য। তাই কৃৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে সম্প্রতি সরকার অনুমোদন দিয়েছে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ’, যা হবে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী কর্মযজ্ঞ। এই মহা কর্মপরিকল্পনায় তিন ধাপে ২০৪১ সাল পর্যন্ত কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২১ সালের মধ্যে শস্য রোপণে ২০ শতাংশ পর্যন্ত যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি করা হবে। রোপণ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার হলেও ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার তা ৮০ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। আর ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্য থাকলেও ’৪১ সালের মধ্যে কৃষির প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যবহারের প্রসার ঘটানোর লক্ষ্য সরকারের। কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রান্তিক কৃষকের মাঝে যান্ত্রিক সুবিধা সম্প্রসারণে কৃষক পর্যায়ে ভাড়ায় কৃষি যন্ত্রপাতি সেবা প্রদান প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

 

কৃষি যন্ত্রপাতির বর্তমান চিত্র তুলে ধরে রোডম্যাপে বলা হয়েছে, কৃষিতে জমি তৈরি, সেচ, শস্য মাড়াই ও মিলিংয়ের কাজ প্রায় পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। তবু কোনো কোনো ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখনও নাজুক। বীজ বপন, রোপণ ও ফসল কর্তনের ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়নি। তবে সম্প্রতি কৃষক পর্যায়ে যন্ত্র ব্যবহারের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকমাত্রায় যন্ত্রের প্রসার ঘটেছে। দিন দিন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরে এতে বলা হয়, যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারই শ্রমিক স্বল্পতার এই অভাব দূর করতে পারে। উত্পাদন বাড়াতে পারে।

 

কৃষি অধিদফতরের তথ্য মতে, উন্নত বিশ্বের কৃষিতে শ্রমিক থাকে ৭-৮%। আমেরিকায় ৩২-৩৩ কোটি মানুষের খাদ্য উত্পাদনে মাত্র ২-৩% লোক কাজ করেন। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ১ কোটি হেক্টর জমি চাষের আওতায় ছিল, আর জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ৪৫ বছর পর চাষযোগ্য জমি কমে দাঁড়িয়েছে ৮০-৮২ লক্ষ হেক্টর। এই জমিতে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য উত্পাদিত হচ্ছে। আমাদের দেশের কৃষিতে শ্রমিক সংখ্যা কিছুদিন আগেও ছিল ৬০-৭০%, বর্তমানে আছে ৪০%।

 

বিএডিসি, বারি, ব্রিসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষি কাজে বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে এমন ইঞ্জিনের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। মাঠে কার্যকর রয়েছে এমন যন্ত্রের সংখ্যা পাওয়ার টিলার ৭ লাখ, ট্রাক্টর ৩৫ হাজার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ৩০০, সিডার ৫ হাজার, দানাদার ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ৮০০, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগযন্ত্র ১৮ হাজার ও স্প্রেয়ার ১৩ লাখ। সারা দেশে সেচ পাম্প (গভীর নলকূপ, অগভীর ও শক্তি চালিত পাম্প) রয়েছে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫২টি, আর সৌর পাম্পের সংখ্যা ৩২০টি। অন্যদিকে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ৮০, উইডার ২ লাখ ৫০ হাজার, রিপার ৫০০, জুট রিবনার ৪০ হাজার, ওপেন ড্রাম থ্রেসার ১ লাখ ৫০ হাজার, ক্লোজড ড্রাম থ্রেসার ২ লাখ ২০ হাজার, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র ১৫ হাজার, আখ মাড়াই যন্ত্র ৫০ হাজার, উইনোয়ার ২ হাজার, ড্রায়ার ৫০০, ধান ভাঙ্গানো যন্ত্র ১৫ হাজার ও ৭০টি ইম্প্রুভড পারবয়েলিং ট্যাংক কৃষি ও কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজে ব্যবহূত হচ্ছে।

 

কৃষি বিজ্ঞানী ড. সিরাজুল ইসলাম জানান, যশোর অঞ্চল কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে পথিকৃত্। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষণা করে। তারা এ পর্যন্ত ৩৫টি কৃষি যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছে। আর সীমিত আকারে হলেও এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। যেমন আলু তোলা মেশিন, ঘাস কাটা মেশিন উল্লেখযোগ্য।

 

এদিকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ অনুযায়ী অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে কিছু প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। এই ক্রমহ্রাসমান জমিতে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য যান্ত্রিকীকরণ অতি জরুরি। পরিকল্পনায় উপযোগী ও গুণগত মানসম্পন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকরণের ওপর জোর দিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, এখন যন্ত্রের ব্যবহার যেখানে বাড়ছে সেখানে এক ফসলী জমি দো ফসলী, দো ফসলী জমি তিন ফসলী হচ্ছে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান বলেন, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি সাথে যেমন কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে, একইভাবে গ্রাম অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে কৃষির উত্পাদনশীলতা ধরে রাখতে কৃষিকে যান্ত্রিক কৃষিতে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। মাঠ চাহিদার নিরিখে কৃষি যন্ত্র উদ্ভাবন, আমদানীকৃত যন্ত্র দেশীয় উপযোগীকরণ ও কৃষক পর্যায়ে সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি আরে বলেন, সরকার কৃষি যন্ত্রপাতিসহ অন্যখাতে প্রণোদনা দিচ্ছে। কৃষিতে যান্ত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হবে অন্যদিকে ফসলের উত্পাদনও বাড়বে