প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দলের সকল নেতাকর্মীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা স্ব স্ব এলাকায় কতজন দরিদ্র ও গৃহহারা মানুষ আছেন, কাদের ঘরবাড়ি নেই, ঠিকানা নেই, কারা রিক্ত-নিঃস্ব, হতদরিদ্র, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী-আপনারা তাদের তালিকা বানান। তারা যেন বেঁচে থাকতে পারেন, এর ব্যবস্থা করে দেব। তারাও এদেশের নাগরিক, তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে।’ দলীয়ভাবে এমন প্রতিশ্রুতি প্রদান বোধহয় এই প্রথম। দারিদ্র্যকে চিরতরে দেশ থেকে উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে ভালোভাবে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে আরও বলেছেন, সরকার, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, দুস্থ নারীদের জন্য ভাতা, মুক্তিযুদ্ধ ভাতাসহ প্রায় ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এবং প্রায় ৫৫ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ এ সকল ভাতার আওতায় এসেছে এবং ২২টি মন্ত্রণালয় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসবই হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ। তবে এজন্য প্রয়োজন হবে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি, অর্থনীতির আরও অধিক প্রাণের সঞ্চার করা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত হিসাবে মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, যা অতীতের সকল অর্জনের চেয়ে বেশি এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলনের সীমাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার হিসাব এবং এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ মহলের ধ্যান-ধারণা বা প্রক্ষেপণকে অতিক্রান্ত করে এক রেকর্ড সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে এবারের প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু এই অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রমাণ করে সত্যিই বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে, যা বিশ্বের অনেক দেশের কাছে চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। মোট দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরে এই জিডিপির পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ১৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। এই হিসাবে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি এবং প্রবৃদ্ধির হারের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে।
এখন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বা গ্রোস ন্যাশনাল ইনকাম (জিএনআই) উপনীত হয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ ডলারে, যা হচ্ছে বড় ধরনের সাফল্য। কিন্তু গরিব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে কি? এ প্রশ্ন দেশবাসীর, অর্থনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের অনেক মানুষের।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ২৫ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে গত অর্থবছরের এই চূূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাপ্ত তথ্যাবলি তুলে ধরে উল্লেখ করেন, এই তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন এই অর্জন দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের অবদানের সুফল। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন দেশের সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে দারিদ্র্য জয়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব।
তবে অনস্বীকার্য যে দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে কমপক্ষে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং তা চলতে হবে কয়েক বছর ধরে। লক্ষণীয় যে, এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়লে দারিদ্র্য কমতে পারে ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। এমন প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করতে পারলে তবেই ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে হতদরিদ্র মানুষের হার ৩ দশমিকের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে, যা হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য।
এখানেই হচ্ছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে দারিদ্র্য নিরসন এবং ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়নের সম্পর্ক। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করব ২০২১ সালে। এই সময়ে দেশের কত লোক দুই বেলা খেতে না পাওয়ার বেদনায় রাত যাপন করবে, এর হিসাব শুরু করতে হবে এখনই। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ লোক হতদরিদ্র। এরা অনেকেই ভিক্ষুক, দুই বেলা খেতে পায় না। হতদরিদ্র লোকজন তাদের অদৃষ্টকে অভিসম্পাত দেয়। অথচ তাদের স্বজন এবং পরিবারের লোকজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, চরম নির্যাতন ভোগ করেছে, দেশ ছেড়ে শরণার্থী হয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার হিসাবে এই ১২ দশমিক ৯ শতাংশ লোক হচ্ছে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ।
এর অর্থ হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ হতদরিদ্র, যারা দুই বেলা খেতে পায় না। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে, বেদনায় অশ্রু বিসর্জন করে নীরবে নিভৃতে। শিক্ষা-সংস্কৃতি-আনন্দ তাদের কাছে অপরিচিত শব্দাবলি। তারা শুধু শুনতে পায় কান্না, নবজাতকের আর্তনাদ, প্রবীণের আহাজারি। পৃথিবীর প্রায় ১৭৫টি দেশ আছে, যাদের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে দুই কোটি থেকে কম।
সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকজন হচ্ছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যার অর্থ হচ্ছে প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এই চার কোটি মানুষ সত্যিই গরিব। জীবনকে উপভোগ করার মতো তাদের কোনো সাশ্রয় নেই। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এমন পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের পরিকল্পনাকারীদের ভাবতে হবে আমরা কি ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে নির্বাসনে পাঠাতে পারব? প্রতিশ্রুতি রক্ষা কি সম্ভব হবে?
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যে প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, সকল প্রকার দারিদ্র্যকে নিরসন করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। পুরুষ-মহিলা ও শিশুদের মধ্যে বিরাজিত দারিদ্র্যকে হ্রাস করে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। অর্থনৈতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশের জন্য সকলের সমান অধিকার ও সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সকল প্রকার বঞ্চনা ও বেদনা থেকে সর্বস্তরের নাগরিককে মুক্ত করতে হবে। ২০৩০ সালের লক্ষ্য হচ্ছে, হতদরিদ্রের হার ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা এবং এই লক্ষ্য অর্জন করতেই হবে। এ হচ্ছে এক কঠিন পরীক্ষা।
বাংলাদেশে যেভাবে প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত আছে, এর ফলে দারিদ্র্য নিরসন কি সম্ভব? কর্মজীবী মানুষের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ এখনও কৃষিনির্ভর। কিন্তু এবারের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর আহরিত তথ্য অনুসারে দেখা যায়, কৃষি খাতে উত্পাদন বাড়েনি, পক্ষান্তরে হ্রাস পেয়েছে। এ খাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কিন্তু এবার হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতির ভিত্তিমূলে প্রবৃদ্ধির গতিবিধি টেকসই হচ্ছে না। বেশিরভাগ শ্রমজীবী/কর্মজীবী মানুষের আয় বাড়েনি। শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে।
শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৯ হারে। অথচ গত অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় আয় বেড়েছে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত কর্মচারীদের। তবে কমপক্ষে আগামী ৫ বছরের এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যার অর্থ হচ্ছে এ খাতে প্রবৃদ্ধি আর বাড়বে না। এ হচ্ছে সরল হিসাব। তবে আরও বিষয় আছে, যা প্রবৃদ্ধির হারকে প্রভাবিত করতে পারে। সেই সূক্ষ্ম আলোচনায় নাইবা গেলাম।
শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রগতি। কিন্তু এই শিল্প হচ্ছে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর শিল্প। অনেক সরঞ্জাম আমদানি করতে হয় এই শিল্পকে রক্ষা করতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো অঘটন ঘটলে অথবা মুদ্রাবাজারে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় হলে এমন শিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। বাংলাদেশের অপর একটি উপার্জন খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। এখানেও কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আশা করা যায় বহুমুখী চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হতে পারে।
এমন সব চ্যালেঞ্জের মাঝেও বাংলাদেশ যে হারে দারিদ্র্য নিরসনের অঙ্গনে অবদান রেখেছে, তা বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে। বড় কথা হল, এদেশে ২০০৫ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশে। অর্থাত্ বিগত ১০ বছরে এমন অসামান্য অগ্রগতি সাধন করেছে, যা বিশ্বে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাই বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম, গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তারা এসেছেন দেখতে এবং অনুধাবন করতে অজেয় মানুষের অপরিসীম শক্তিকে, যা তারা ১৯৭১ সালে দেখলেও বুঝতে পারেনি। তাই ভরসা করা যায় বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। তবে এজন্য প্রয়োজন হবে জাতীয় চেতনায় ঐক্যের সুর, কর্মে থাকতে হবে উত্সাহ ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবনা এবং এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকেই।