এক অজপাড়ার নাম পূর্ব মৌকুড়ী গ্রাম। এখানকার জরাজীর্ণ একটি ঘর থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে আলো। এটা বিদ্যুতের আলো নয়, শিক্ষার আলো। মজার ব্যাপার হলো, শিশুদের মাঝে এ আলো ছড়াচ্ছে শিশুরাই। বলছিলাম রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পূর্ব মৌকুড়ী গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের কথা। এ গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, একটা সময় এখানকার বাসিন্দারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবতেনও না। এখন অবস্থা বদলেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা শিখছে। স্বপ্ন দেখছে বড় হওয়ার। এখানকার শিশুদের আলোর পথ দেখানো এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রয়াসে নিজেরাই ‘পূর্ব মৌকুড়ী আদিবাসী পাড়া সংঘ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছে। এর কর্মকর্তারা বাচ্চাদের পড়ালেখার বিষয়টি দেখভাল করেন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত কুমার সরদার পাইলট জানান, এ পল্লীর ৪৪টি পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তারা কখনও পড়ালেখার সুযোগ পাওয়ার কথা ভাবতে পারেনি। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। এ পল্লীর ছেলেমেয়েরা প্রাথমিকের গ-ি পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরের বারান্দায় খেজুরের মাদুর বিছিয়ে ২০ থেকে ২৫ শিশু লেখাপড়া করছে। এদের মধ্যে যারা বড়, তারা শিক্ষক, আর ছোটরা শিক্ষার্থী। বালিয়াকান্দি পাইলট উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী পলি সরদার ও শহীদ জিয়া আইডিয়াল একাডেমির অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শাপলা সরদার জানায়, অর্থের অভাবে আমরা প্রাইভেট পড়তে পারি না। তাই আমরা যারা বড়, তারা প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের প্রতিদিন সকালে ১ ঘণ্টা করে বিদ্যালয়ের পড়া তৈরি করে দিই।
বালিয়াকান্দি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী বৈশাখী সরদার বলে, আমাদের এ আদিবাসী পল্লীর মেয়েদের একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমরা পড়েছি বাল্যবিয়ে অপরাধ। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ে নয় লেখাপড়া করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করব। ব্র্যাক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আকাশ জানায়, অর্থের অভাবে বাবা আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চায়। কিন্তু আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করব না। স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি বাবাকেও সহযোগিতা করব। লেখাপড়া শিখে আমি বড় হতে চাই। আকাশের বাবা বিকাশ সরদার জানান, প্রতিনিয়ত আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। সেখানে কীভাবে সন্তানকে লেখাপড়া করাব বুঝতে পারছি না। তার পরেও আমার কষ্ট হলেও ওকে লেখাপড়া শেখাব। ওর স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করব। শুধু আকাশই নয়, এরকম অর্ধশতাধিক আদিবাসী শিশু শিক্ষার্থীর চোখেমুখে এখন শিক্ষার স্বপ্ন; ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানোর স্বপ্ন।