লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধান উদ্ভাবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সাগরের পানির উচ্চতা। এতে লবণাক্ত পানির প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের আবাদি জমি হয়ে পড়ছে চাষের অনুপযোগী। আর এই লবণাক্ত আবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন লবণাক্ততা ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু ব্রি ধান-৭৮। জাতটিতে একই সঙ্গে লবণাক্ততা ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু জিন সন্নিবেশ করা হয়েছে। এটি উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত পানিতে প্রায় ১২ দিন পর্যন্ত নিমজ্জিত থেকে বাঁচতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশেও প্রতি হেক্টরে এটি পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় টন ফলন দেয় এবং এ উৎপাদনের পরিমাণ সাধারণ জাতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া স্থানীয় লবণাক্ততা ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু জাতের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন আগে এটি ঘরে তোলা যায়। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ঝঞজঅঝঅ-ইগত প্রকল্পের আওতায় ২০০৯ সালে ওই কৌলিক সারিটির এফ৬ জেনারেশন ব্রি’তে আনা হয়। উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও লবণাক্ততাপ্রবণ অঞ্চলে চাষাবাদের উপযোগী জাতটি চারা অবস্থায় ৬-ডেসি সেমি (ডিএস/মি.) মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।

শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য : জাতটিতে আধুনিক উফশি ধানের সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এর ডিগপাতা খাড়া ও লম্বা। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর কুশিগুলো গাছের গোড়ার দিকে ঘনভাবে সন্নিবেশিত থাকে। চারা বেশ লম্বা হয়। পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা প্রায় ১২০ সেমি, যা রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জন্য উপযোগী। এর জীবনকাল ১৩৩ থেকে ১৩৬ দিন। ধানের রঙ সোনালি; আকৃতি চিকন ও মাঝারি লম্বা। চাল মাঝারি লম্বা, চিকন। ভাত ঝরঝরে ও সাদা হয়। এর জীবনকাল ব্রি ধান-৪১ এর চেয়ে ৭ থেকে ১০ দিন আগাম। রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও লবণাক্ততাপ্রবণ অঞ্চলে ব্রি ধান-৪১ এর চেয়ে ভালোভাবে টিকে থাকে এবং বেশি ফলন দিয়ে থাকে। রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় জোয়ার-ভাটায় ৮ থেকে ৯ দিন নিমজ্জিত থেকেও বেশি ফলন দেয়।
চাষাবাদ পদ্ধতি : চাষাবাদ পদ্ধতিও অন্যান্য উপকূলীয় উফশী আমন ধানের মতোই। লবণাক্ততামুক্ত বীজতলায় এর বীজ বপন করতে হয়। বপনের উপযুক্ত সময় হলো ২৫ জুন থেকে ১০ জুলাই। রোপা আমন মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের লম্বা চারা উপকূলীয় জোয়ার-ভাটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে গোছাপ্রতি ২ থেকে ৩টি করে চারা ২০ সেমি এবং ১৫ সেমি দূরত্বে রোপণ করতে হবে। ২৫ থেকে ৩০ সেমি জোয়ারের গভীরে মাঝারি উঁচু থেকে নিচু জমি এ ধানের লম্বা চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত। এতে সার প্রয়োগ করতে হবে হেক্টরপ্রতি ১৫০ কেজি ইউরিয়া, ১০০ কেজি টিএসপি, ৭০ কেজি এমপি, ৬০ কেজি জিপসাম ও ১০ কেজি জিঙ্ক সালফেট। অগভীর জোয়ারের সময়, সর্বশেষ জমি চাষের সময় সব টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে ইউরিয়া সার সমান তিন কিস্তিতে দিতে হয়। রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন পর ১ম কিস্তি, ৩০ দিন পর ২য় কিস্তি এবং ৪৫ দিন পর ৩য় কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। অগভীর জোয়ারের সময়কালের সঙ্গে মিল করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে, জোয়ারের গভীরতা ২০ থেকে ২৫ সেমির বেশি হলে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যাবে না। এখানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যান্য জাতের চেয়ে অনেক কম হয়।
আঞ্চলিক উপযোগিতা ও ফলন : রোপা আমন মৌসুমে এটি সাতক্ষীরা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও লবণাক্ততাপ্রবণ (৬-৮ ফঝ/স) অঞ্চলের জন্য জাত হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ার-ভাটায় ১২ দিন নিমজ্জিত থেকেও বেশি ফলন দিয়ে থাকে। রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও লবণাক্ততাপ্রবণ অঞ্চলে ব্রি ধান-৭৮ লবণাক্ততার মাত্রা ভেদে হেক্টরপ্রতি ৪.৫ থেকে ৪.৭ টন ফলন দিতে পারে। লবণাক্ততার মাত্রা কম হলে, উপযুক্ত পরিচর্যা ব্রি ধান-৭৮ হেক্টরপ্রতি ৫.৫ থেকে ৬.০ টন ফলন দিতে সক্ষম।
নতুন এ জাতটি সম্পর্কে ব্রি’র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম মাসুদুজ্জামান বলেন, এটি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত কোনো জাত, যেটি সাগরের লবণাক্ততা ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু। এর উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৫.৫ থেকে ৬ টন। এটি স্থানীয় সাদা মোটা, লাল মোটা ও রাজা সাই নামক জাতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ফলন দেয়। এর ফসল ঘরে তোলা যায় স্থানীয় জাতের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন আগে। এতে একদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের অনাবাদি জমি যেমন চাষের আওতায় আসবে, অন্যদিকে কৃষকরাও লাভবান হবেন।