দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য

লেখক : রেজাউল করিম খোকন, ব্যাংকার

বিশ্বে এখন হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৭৭ কোটি, যাদের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম। তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বা ৩৯ কোটির বাস সাব-সাহারা অঞ্চলে। আর ৩৪ শতাংশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বিশ্বব্যাংকের এই তথ্যের বিপরীত অবস্থানে রয়েছে এখন বাংলাদেশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০০৫ সালেও দেশে যেখানে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৩ শতাংশ, দশ বছরের ব্যবধানে তা কমে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। সংখ্যায় বললে দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এখন অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের মতে, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের উচিত কীভাবে দারিদ্র্য দূর করতে হয়, তা বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখা। তার মতে, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে।
হতদরিদ্র লোকের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের একটি হল বাংলাদেশ। এই তালিকায় শীর্ষে থাকা ভারতে প্রায় ২৫ কোটি লোক অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতি দারিদ্র্যের হার কমেছে। এই প্রবণতাকে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হিসেবে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য এসেছে। সরকার গত ছয় বছরে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সারাদেশে সড়ক নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগণ। এখন গ্রামের সাধারণ কৃষক তার উত্পাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারণে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য অনেকটাই কমে আসছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমার প্রধান কারণ, এ দেশের মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। ২০০৫ সালের ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) অনুসারে এক ডলারের মূল্যমান ছিল ৫২ টাকা ৪ পয়সা। ২০১১ সালের নতুন হিসাবে তা ২৪ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৫ সাল থেকে পিপিপির এ নতুন হিসাব বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে নতুন হিসাব অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে ১ হাজার ২৯৭ টাকার বেশি আয় করেন, তবে তিনি হতদরিদ্র নন।
বাংলাদেশের মানুষ একসময় দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত ছিল, এ কথা সত্যি। তবে তখন নানা প্রতিবন্ধকতা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক দ্বিধাবিভক্তি, দায়সারা মনোভাব, নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত, জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের অশুভ তত্পরতা প্রভৃতি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে এখন আগের সেই অবস্থা নেই। নানা চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে আরও আগেই। এ দেশের মানুষের প্রাণশক্তি অনেক বেশি, তারাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সার্বিক দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিও, সুশীল সমাজের ভূমিকাও আছে। অর্থনৈতিক উন্নতির কারণেই চরম দরিদ্রের সংখ্যা কমছে। এত সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পরে দেশে এখনও প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম দরিদ্র। সংখ্যার দিক থেকে এটি অনেক বেশি। বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য বিদায় নিয়েছে, তেমন দাবি করার সময় আসতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে-এটা ভাবলে হবে না। তবে দারিদ্র্যের চেহারাও বদলেছে। নগর দারিদ্র্য বেড়েছে, যা নতুন এক চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বৈষম্যও জোরালো হয়েছে।
এ প্রবণতায় দারিদ্র্য কমলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দারিদ্র্য বিমোচনের প্রথম লক্ষ্যটি অর্জিত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকই এই সংশয় প্রকাশ করেছে। এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় প্রবৃদ্ধি হিসাব করে দেখা গেছে, ওই সময়ে প্রতি বছরে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ দারিদ্র্য কমেছে। এ সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের এ ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালে এ দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। একইভাবে ২০০৫-এর পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক দশমিক ৯২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। আগের পাঁচ বছরের তুলনায় কম অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে এ দারিদ্র্য হার ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছবে। প্রতি বছর দারিদ্র্য হ্রাসের হার দশমিক ৯২ শতাংশ বজায় রেখে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এটি সত্যি বেশ চ্যালেঞ্জিং। আর ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাসের ধারা বজায় থাকলে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। একটি কথা বিশেষভাবে মানতেই হবে, নিচের দিকে থাকা দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ যদি প্রবৃদ্ধির সুফল পায়, তবে তা দারিদ্র্য বিমোচনে বেশি কার্যকর হয়। বাংলাদেশে এ জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু ভোক্তা প্রবৃদ্ধির হার জাতীয় ভোক্তা প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে দশমিক ৪৩ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আশপাশের দেশ পাকিস্তান, ভারত ও ভুটানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে। একটি বিষয় সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে, তা হল কোনো দেশের অর্থনীতি কীভাবে বাড়ছে। এর ওপর দারিদ্র্য হার কমার বিষয়টি নির্ভর করে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, গরিব মানুষ যদি এর সুফল বেশি পায়, তাহলে সেই দেশের দারিদ্র্য দ্রুত হ্রাস পাবে।
কাঙ্ক্ষিত পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সূচকে একের পর এক উঠে আসছে তারই স্বীকৃতি। এ ধারায় সর্বশেষ সংযোজন দারিদ্র্য জয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্য। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একাত্তরে বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছিল। পাকিস্তানি শোষণের কারণে তখন এ দেশে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। এখন সেই পাকিস্তান আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। তাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ধারণা করা যায়, আগামীতে আরও পিছিয়ে পড়বে পাকিস্তান। স্বাধীনতা ক্রমেই তার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে বহুল উচ্চারিত বিশ্বকবির ‘সোনার বাংলা’ অভিধা বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করেছে। আর এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব এবং দেশ পরিচালনায় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির কাঙ্ক্ষিত অংশগ্রহণ। সে কারণেই বঙ্গোপসাগরের বিশাল অংশজুড়ে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ছিটমহল ও স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য এসেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ চমত্কারভাবে এগিয়ে চলেছে, বিদ্যুত্ উত্পাদনে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে, দিনে দিনে এ ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটেছে, কৃষি ও শিল্পোত্পাদন দ্রুত বাড়ছে। অন্যদিকে দারিদ্র্য দ্রুত পিছু হটছে। মানুষের গড় আয় বেড়েছে, কর্মসংস্থান ও আয় উপার্জন বেড়েছে, সব শ্রেণির মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।
আজ অনেকটা সগৌরবে বলা যায়, মাঝখানে দীর্ঘ একটা সময় দেশ বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দি ছিল, সেই সময়টাতে দেশ নানাভাবে হোঁচট খেলেও আবার স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। আমরা দেশের ১৬ কোটি মানুষ একমনে কামনা করি, বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক এবং অতি দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অপুষ্টি চিরতরে নির্বাসিত হোক এই প্রিয় ভূখণ্ড থেকে।