সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পনাজমুল লিখন, রূপপুর থেকে ফিরে: পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মাপারের রূপপুর ছিল একসময়কার বিরানভূমি। সেখানেই ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ। ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। মূল বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হবে আগামী বছর।সবকিছু ঠিক থাকলে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতার প্রথম চুল্লি বিদ্যুত্ দেবে ২০২২ সালে। একই ক্ষমতার আরেকটি চুল্লি তার পরের বছরই শুরু করবে উত্পাদন। উত্পাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের মূল্য হবে সাড়ে তিন টাকা। এই কেন্দ্রের স্থায়িত্ব (লাইফ টাইম) হবে পঞ্চাশ বছর, যা পরবর্তীতে আরও ত্রিশ বছর বাড়ানো সম্ভব।

পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম পোড়ানোর ফলে উত্পন্ন হয় তাপ। উত্পন্ন তাপ ব্রয়লারের মাধ্যমে পানিকে বাষ্প করে। সে বাষ্প টারবাইন ঘোরাবে। এই টারবাইনের সঙ্গে যুক্ত জেনারেটর অলটারনেটের মাধ্যমে উত্পাদন হবে বিদ্যুত্।
ষাটের দশকে নেওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবে ধরা দিতে শুরু করে বছর তিনেক আগে। ইতোমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ চুক্তি হয়েছে। রুশ ফেডারেশনের সহযোগিতায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পের কাজ চলছে বেশ জোর কদমেই।

সম্প্রতি প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও নির্মাণ শ্রমিকরা নিরলসভাবে কাজ করছেন। এখন চলছে চুল্লি বসানোর আগে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নসহ সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক নির্মাণ কাজ। এর মধ্যে রয়েছে-ভূমি উন্নয়ন, মনিটরিং স্টেশন, মাটি পরীক্ষাগার ও কনস্ট্রাকশন ল্যাবরেটরি, কনক্রিট বেসিং প্লাট, ওয়্যার হাউজ, ওয়ার্কশপ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, প্রাথমিক চিকিত্সাকেন্দ্র, অফিস ভবন, কেন্টিন ইত্যাদি। এ ছাড়া অগ্নি নির্বাপণ ও অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজও চলছে সেখানে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এসব কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।
কর্মকর্তারা জানালেন, বিদ্যুেকন্দ্র তৈরির মূল কাজ শুরু হবে ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে। সে হিসেবে অন্যান্য কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকায় এবং এর বাইরে বিদেশিরা যেখানে অবস্থান করছেন সেখানে ব্যাপক নিরাপত্তা চোখে পড়ল। পরমাণু শক্তি কমিশনের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াও আনসার, র্যাব-পুলিশ, বিজিবি পাহারা দিচ্ছে তাদের। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও টহল দেওয়া হয় প্রকল্প এলাকায়।
বর্জ্য অপসারণের বিষয় চূড়ান্ত হয়নি এখনও : পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের সময় ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উত্পন্ন হবে, যা রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। তবে এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে গত দুই সপ্তাহ ধরে জোর আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে বিদ্যুেকন্দ্র পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হবে। মূল কাজ শুরুর আগে এসব বিষয়ে চুক্তি হবে।
ব্যয় ও অন্যান্য : রূপপুর কেন্দ্র স্থাপনে সরকার ও রাশিয়ার মধ্যে সই হওয়া মূল চুক্তি অনুযায়ী এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি (১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার)। এর মধ্যে বাংলাদেশ দশ শতাংশ এবং রাশিয়া ৯০ শতাংশ ঋণে অর্থায়ন করবে। রাশিয়ার এই ঋণ সহজ শর্তে ২৮ বছরে পরিশোধযোগ্য। বাংলাদেশে এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প। এই কেন্দ্র থেকে উত্পাদিত মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ ব্যয় হবে বিদ্যুেকন্দ্র পরিচালনায়। প্রতিবছর কেন্দ্রটিতে জ্বালানি বাবদ খরচ হবে ১৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ইউনিটের জ্বালানি খরচ হবে দশমিক ৭৯ সেন্ট। বার্ষিক অপারেশন ও মেইনটেনেন্স বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেছেন, মেয়াদ শেষে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার (ডিকমিশনিং) জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার রাখা হবে। এই অর্থ আসবে বিদ্যুেকন্দ্র চালু হওয়ার পর বিদ্যুত্ বিক্রির টাকা থেকে।

নিরাপত্তা : পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র হওয়ায় শুরু থেকেই কেন্দ্রটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে রাশিয়ার তৈরি ‘ভিভিইআর-১২০০’ প্রযুক্তির পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হবে। এটি ‘থ্রি প্লাস’ জেনারেশনের প্রযুক্তি, বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতে যা এখন পর্যন্ত সর্বাধিক নিরাপদ।

রূপপুরে ব্যবহূত ভিভিইআর ১২০০ প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টরের পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। রিঅ্যাক্টরটি মনুষ্যসৃষ্ট যেকোনো বিপর্যয় এবং প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে এমন যেকোনো দুর্ঘটনা যেমন-শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা মোকাবেলায় সক্ষম হবে। বিগত একশ’ বছরের ভূমিকম্প জরিপ বিশ্লেষণ করে এখানে ভূমির স্থায়িত্ব রক্ষায় জার্মানির সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জুলকারনাইন বলেন, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইইএ’র নির্দেশনা মেনেই কাজ করছেন তারা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পে বিশ্বের সর্বাধুনিক রিঅ্যাক্টর (চুল্লি) ব্যবহার করা হবে। ভিভিইআর ১২০০ প্রযুক্তির এই রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করে ইতোমধ্যে রাশিয়া নিজ দেশে একটি পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করেছে। এই প্রযুক্তি অত্যন্ত নিরাপদ।

পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রে প্রতিনিয়ত চুল্লিতে বসানো যন্ত্রপাতি ঠাণ্ডা রাখতে হয়। চুল্লি নিরাপদ রাখতে পানির ব্যবহার তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন প্রথম পরিকল্পনা হয় রূপপুর নিয়ে তখন পদ্মা নদী ছিল প্রমত্তা। কিন্তু এখন পানির প্রবাহ কমেছে। ফলে এই বিদ্যুত্ প্রকল্পের স্বপ্নযাত্রায় বাদ সাধতে পারে পদ্মা নদীর পানির অপ্রতুলতা। সঙ্গে আছে ভারি যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়ার চ্যালেঞ্জ।
বিদ্যুেকন্দ্রটির নির্মাণ পর্যায়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৭৫০ কিউবিক মিটার পানি লাগবে। আর বিদ্যুেকন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য বছরে প্রয়োজন হবে ৮১ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানির কম ব্যবহারের জন্য কুলিং টাওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার হবে রূপপুরে। ফলে যত পানি প্রয়োজন তার মধ্যে রিসাইক্লিং হিসেবে প্রায় অর্ধেক পানি পুনরায় ব্যবহার হবে। যে বাষ্প শক্তি জোগাবে বিদ্যুত্ উত্পাদনের সেই বাষ্প কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে আবার পানিতে পরিণত হয়ে ব্যবহূত হবে যন্ত্রপাতি ঠাণ্ডা রাখতে। তবে কিছু পানি ব্যবহারের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নদীতে ছাড়া হবে। ফলে এই পানি জলজ প্রাণীর কোনো ক্ষতি করবে না। বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের উত্স রাখা হবে। আর ভারি যন্ত্রপাতি আনা হবে নদীপথে বর্ষাকালে।