প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নীতিমালা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে হচ্ছে বিশেষায়িত এমপিওভুক্ত স্কুল

প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করছে সরকার। নীতিমালায় সারা দেশের উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একটি করে বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং তা সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রায় আড়াই লাখ প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বর্তমানে সারা দেশের জেলা পর্যায়ে মাত্র দেড় শতাধিক সরকারি এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালা কার্যকর হলে দেশে ৬০৬টি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে।

‘প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০১৬’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবির জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকার, সুইড বাংলাদেশসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০০৯ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এখন সারা দেশেই প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ তৈরি ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য সামগ্রিকভাবে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আনোয়ার উল্লাহ বলেন, দেশে বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত নয়। তাদের জন্য মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সারা দেশের জন্যই একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ নীতিমালার বিশেষ দিক হচ্ছে—এর মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষামানের সঙ্গে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষামানের সমন্বয় করা হচ্ছে। ফলে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উত্তীর্ণ সার্টিফিকেটধারীরা সমমানের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার সুযোগ পাবে। বর্তমানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এ সুযোগ নেই।

নীতিমালায় বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, পাঠদান পদ্ধতি, পাঠ্যসূচি, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ সামগ্রিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে প্রতিবন্ধী শিশুদের সহজভাবে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে সাধারণ স্কুলে যাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা এবং জীবনদক্ষতা উন্নয়নে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে পুনর্বাসন করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নীতিমালার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ বছরের মধ্যেই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতি উপজেলায় একটি, সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনটি, পুরান জেলা সদরে দুটি, নতুন জেলা সদরে একটি বিশেষ স্কুল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচটি করে এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় দুটি স্কুলের প্রস্তাব রয়েছে। নতুন স্কুলের জন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচ শতক বা দুই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, জেলা সদরের জন্য ১০ শতক এবং উপজেলা পর্যায়ে ১৫ শতক জমি থাকতে হবে। ব্যক্তির নামে স্কুল করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নামে পাঁচ লাখ টাকা এককালীন দিতে হবে। দাতা সদস্যের জন্য এককালীন এক লাখ টাকা দিতে হবে।

নীতিমালা অনুসারে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। তবে হাওর, চরাঞ্চল, পশ্চাত্পদ এলাকা ও পার্বত্য জেলাগুলোর ক্ষেত্রে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুসারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ৫০ জন শিক্ষার্থীর স্কুলে জনবল কাঠামো হবে ১৬ জনের।

স্কুলগুলোর শিক্ষাক্রম, পাঠসূচি, পরিদর্শন, তদারকি, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন সেল ফর স্পেশাল স্কুল (এমইসিএসএস)। এটি জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে।

স্কুল স্থাপনের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো নির্ধারিত ফরমে সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবেদন করতে হবে। সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বীকৃতি দেবে। এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো এসব স্কুলের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেবে। প্রতিটি স্কুলে তিন বছরমেয়াদি ম্যানেজিং কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধি, অভিভাবক, দাতা, এনজিও ও শিক্ষকদের প্রতিনিধি থাকবে। প্রতিবছর স্কুলের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে।

নীতিমালায় স্কুল প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মধ্যে সরকার নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জনের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, মৃদুমাত্রার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ প্রাথমিক এবং ১৫ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে হবে। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তির যোগ্য করতে হবে এবং ৬০ শতাংশকে এসএসসি পাস করাতে হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ৮০ শতাংশকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের যোগ্য করতে হবে। ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং ৬৫ শতাংশকে এসএসসি পাস করাতে হবে।

বর্তমানে সরকারিভাবে ৬৪ জেলায় একটি করে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল, শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাতটি স্কুল, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য পাঁচটি স্কুল ও অটিস্টিক শিশুদের জন্য ১০টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি অর্থায়নে বেসরকারিভাবে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ৬২টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত ৪৮টি, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত সাতটি ইনক্লুসিভ স্কুল এবং প্রয়াস পরিচালিত একটি অটিস্টিক স্কুল রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুরে ‘জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র’ রয়েছে।