বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা

বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ এখন সবারই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, ডান-বাম, মধ্যপ্রাচ্য-দূরপ্রাচ্য সবাই একবার হলেও এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখে অবাক বিস্ময়ে। ইতিহাস বলে, একসময় এমনিভাবে সারাবিশ্ব দেখত এতদঞ্চলের জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরের দিকে। তারপর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে দেখা গেছে ভারত ও চীনকে। বাংলাদেশকে বলা হয় উদীয়মান ব্যাঘ্র। সেটি রূপক অর্থে ব্যবহূত হলেও তা বাংলাদেশের জন্য এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেভাবে উত্তরোত্তর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে তাকে উদীয়মান ব্যাঘ্র বলাই সমীচীন। কিন্তু কেমনে বাংলাদেশ আজকে এমনভাবে এগিয়ে চলছে পাগলা ঘোড়ার মতো! সেটি কি হঠাত্ করে, নাকি এর পেছনে অন্য আরও কোনো মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে? এককথায় এর সদুত্তর হল নেতৃত্ব। এদেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধু যেমন তাঁর সারাজীবন উত্সর্গ করেছিলেন, আজ তেমনি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সেই উচ্চতায় চলে যাচ্ছে, যা স্বাধীনতার আগে-পরে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন।
কথায় আছে, পেটে যদি ক্ষুধার জ্বালা থাকে পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি মনে হয়। তখন পেটের ক্ষুধা নিবারণ করা ছাড়া আর কোনো কিছুই চিন্তা করা যায় না। আস্তে আস্তে এখন বাংলাদেশের পেটের ক্ষুধা মেটার দিকে যাচ্ছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যতগুলো সূচকের উন্নয়ন ঘটলে সে দেশটিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, এখন বাংলাদেশের সবক’টি সূচকেরই ঊর্ধ্বমুখী গতি চোখে পড়ার মতো। এই তো মাত্র দু’মাস আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকিস্তানের হয়ে লড়েছে এবং স্বাধীন হওয়ার পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব কখনই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এসে বাংলাদেশে সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার তো সম্পন্ন করেছেনই, উপরন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহতা দেখার জন্য ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। সেখানে শোকবইতে তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে’। এটি একদিকে যেমন সরকারের সাফল্যের স্বীকৃতি, অপরদিকে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে আবারও নতুনভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঢেলে সাজানো।
গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করে বাংলাদেশের অনুকূলে দীর্ঘদিনের অনেক অনিষ্পত্তিকৃত ইস্যু নিয়ে সহযোগিতামূলক সমঝোতা করে গেছেন। ৬৮ বছরের সমস্যাযুক্ত ছিটমহলগুলো হস্তান্তর ছিল এর মধ্যে অন্যতম। সেখানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকারের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছিল। চলতি মাসেই সফর করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীন এখন বিনিয়োগের অন্যতম দেশ। তারা বিশ্বের প্রায় ১২৪টি দেশে তাদের বিনিয়োগকে সম্প্রসারিত করেছে। এরই অংশ হিসেবে চীন যখন দেখেছে যে এখন বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে এবং সুশৃঙ্খলভাবে বিনিয়োগ কাজে লাগিয়ে তা আবার সঠিক সময়ে পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করেছে, ঠিক তখনই চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে নতুন নতুন ক্ষেত্রে ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হল বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো সাহস দেখিয়ে সফলভাবে তা করে দেখানোর দ্বারপ্রান্তে চলে আসা। চীনের সঙ্গে ২৮টি প্রকল্প চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে ২২ বিলিয়ন ডলারের নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে থাকে। দারিদ্র্য একটি ভয়াবহ সামাজিক রোগ। এটি বিশ্বে মরণব্যাধির মতো ছড়িয়ে রয়েছে। দারিদ্র্যের কথা উঠলেই ক্ষুধার্ত কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেসব মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে খেয়ে না খেয়ে তাদের দিনাতিপাত করছে। আর আজকের বিশ্বে দখল-পাল্টাদখল, যুদ্ধবিগ্রহ সবকিছুর মূলে কিন্তু এ খাদ্যচাহিদা। কারণ মানুষের সবক’টি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। এ খাবারের জন্যই মানুষে মানুষে এত হানাহানি, রেষারেষি। যারা তিন বেলা তাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে খাবার খেতে পায় না। সেই সঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারে না তখন তাদেরকে দরিদ্র বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাই এ খাবারের জন্য হানাহানি হয়েছে ও হচ্ছে। আর সেটি আরও বেশি করে হয়েছে ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে। কারণ ধনী দেশগুলো দরিদ্রের সম্পদ শোষণ করেই প্রচুর অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে থাকে। সেজন্য ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে খাবারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ একত্রিত হয়ে সারাবিশ্ব থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এক সমাবেশে যোগ দিয়েছিল। সেদিন ছিল ১৭ অক্টোবর। সেজন্য জাতিসংঘ কর্তৃক সেদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তখন থেকেই ওই দিনটিকে ‘বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতি বছর জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের অন্যতম সহযোগী সংগঠন হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রতি বছর বিশ্বে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল কোনো দেশে তা ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে। গেল বছর ঘানাতে দিবসটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পালন করা হয়েছে। আর এটি আমাদের বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে, এবারের দিবসটি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশে পালন করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নিন্দুকদের কাছে একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ ছিল সেই তারাই এখন বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে সার্টিফিকেট দিচ্ছে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্য দেখে সন্তুষ্ট হয়ে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, এই তো সেদিন মাত্র ২০০৫ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৩ শতাংশ। সেটি ২০০৯-১০ সালে কমে এসে দাঁড়িয়েছিল ১৮.৫ শতাংশে। আবার গত বছর অর্থাত্ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৯ শতাংশে, যা স্বয়ং বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এ সময়ে তা আরও কমে বর্তমানে ১২.১ শতাংশ। এ সংখ্যা আগামী দিনে আরও কমে আসবে অর্থাত্ জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে নির্ধারিত সময়সীমা ২০৩০ সালের আগেই বাংলাদেশ তা অর্জনের আশা রাখে। হতদরিদ্রের হার ৩ শতাংশের নিচে গেলেই তাকে শূন্য দারিদ্র্য ধরে নেওয়া হয়। সেজন্য এ ধারায় ১.৫ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন অব্যাহত থাকলেই এসডিজির নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ তা অর্জনে সমর্থ হবে।
বাংলাদেশ বিগত দুই দশকে দুই কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পেরেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের এ অর্জন একটি মিরাকল হিসেবে সবার কাছে পরিগণিত এবং বর্তমানে সেটি বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলেও মনে করছে খোদ বিশ্বব্যাংক। অথচ এ বিশ্বব্যাংকই ২০১২ সালে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় সেখানে অর্থায়ন থেকে বিরত ছিল।
তারপরও এ দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে আত্মতুষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশসহ বিশ্বকে দারিদ্র্য বিমোচনে আরও অনেক দূরে এগোতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি বাস্তবায়নে যারা সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে তারাই এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ঘোষিত এসডিজিতে যারা এগিয়ে যেতে পারবে তারা সামনের দিনে দারিদ্র্য বিমোচনে আরও এগিয়ে যেতে পারবে। এর বাইরেও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের রয়েছে নিজস্ব রূপকল্প-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১, যাদের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত একটি দেশে পরিণত হবে। আর এখন থেকেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে দারিদ্র্য বিমোচনে অন্যতম রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সেজন্য ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ভারতের উপকূলীয় পর্যটন নগরী গোয়ায় অনুষ্ঠিত দুটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক আউটরিচ সম্মেলনে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত অর্থনৈতকি জোট ব্রিকস এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বঙ্গোপসাগর এলাকার একটি আঞ্চলিক সংগঠন বিমসটেক মিলে এক টেবিলে একটি দু’দিনব্যাপী সম্মেলনে শেখ হাসিনা ছাড়াও সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ অন্য প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখানে মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনসহ সন্ত্রাসবাদ দমনে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। এ সকল প্রত্যেকটি ফোরামেই এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাফল্যের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। কারণ কম মাথাপিছু আয় নিয়েও যে মানুষের সেবার খাতগুলোতে উন্নতি করা সম্ভব এবং ধারাবাহিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হল আমাদের বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। তাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সকলকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।