দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১২ অক্টোবর হতে ২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী শুরু হয়েছে মা ইলিশ সুরক্ষা অভিযান। এই ২২ দিন ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাসহ দেশের ২৭ জেলায় ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। জেলাগুলো হচ্ছে- চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী। ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এলাকাসমূহ হচ্ছে- ভোলা জেলার মনপুরা ও ঢালচর এবং নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, কালিরচর ও মৌলভীরচর।ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনা পানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। মিঠা পানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৬ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তীতে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছরে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠা পানির দিকে অভিপ্রয়ান করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের ১ম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত: ডিম ছাড়ে। এজন্য ইলিশ কিছুটা রোমান্টিকও বটে । একটি ইলিশে দেড় থেকে ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম থাকে।ইলিশ একটি অভিপ্রয়ানকারী মাছ। এরা স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত অভিপ্রয়ান করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% ইলিশ বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মায়ানমার (২০-২৫%) এবং ৩য় অবস্থানে ভারত (১৫-২০%)। উল্লেখ্য, ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অপর ১০টি দেশেই ইলিশ উৎপাদন কমেছে। সুষ্ঠু ও সঠিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের কারণে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন সাম্প্রতিককালে প্রতি বছর ৯-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আয়ুষ্কালের মধ্যে প্রথম দুই বছর পুরুষ ও স্ত্রী মাছ একই হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু, ৩য় বছরে গিয়ে স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের তুলনায় অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোরতা ইলিশ) সারাজীবন সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠা পানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত করে।স্বাদে ও গন্ধে বাংলাদেশের ইলিশ অতুলনীয়। সুস্বাদু এই মাছটি একসময় দেশের প্রায় সব প্রধান নদ-নদীতে পাওয়া যেত। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, রূপসা, কর্ণফুলী ইত্যাদি প্রধান নদ-নদী ছাড়াও ফেনী, মাতামুহুরী, শিবসা, বিষখালী, পায়রা, গড়াই, কুমার, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা এবং বুড়ীগঙ্গা নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। নদীতে পলি পড়ে ইলিশের অভিপ্রয়ান পথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, অবাধে জাটকা ও মা ইলিশ নিধন, নদী দূষণ প্রধানত এসব কারণে ইলিশের উৎপাদন আশির দশকের গোড়ার দিকে মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। অতঃপর ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) ধারাবাহিক গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণার মাধ্যমে ইনস্টিটিউট থেকে জাটকার বিচরণ ক্ষেত্র, ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও প্রজনন মৌসুম চিহ্নিত করা হয়। এসব গবেষণা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন করা হয় এবং মৎস্য অধিদপ্তর তা বাস্তবায়ন করে। ব্যবস্থাপনা কৌশলের মধ্যে ৫টি অভয়াশ্রমে জাটকা ধরা এবং প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার কার্যক্রম অন্যতম।ইলিশ আহরণকারী জেলেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি জাটকা ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে ২ লাখ ৩৬ হাজার জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে চাল এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য অন্যান্য সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী, নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড, র্যাব, বিজিবি, পুলিশ এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। সাম্প্রতিক সময়ে জোরদার করা হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কার্যক্রম। মন্ত্রণালয়ের এসব দূরদর্শী কৌশল ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। ফলে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লাখ টন; ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয় ৩.৮৭ লাখ টন। ২০১৫-১৬ সালে তা প্রায় ৪.০ লাখ টনে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিগত ৮ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য মতে জানা গেছে যে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মেদির হাওরেও এ বছর ইলিশ পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদপ্তর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে- যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য।মা ইলিশ ও জাটকা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের ফলে দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত এখন বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল অনেকাংশে অনুসরণ করছে। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে।চলতি বছরে ইলিশ উৎপাদনের এই সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। মা ইলিশ ধরা বন্ধকালীন সময়ে ৩ লাখ ৫৭ হাজার পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। এটি একটি নতুন সংযোজন। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পেরেছে যে, মা ইলিশ ও জাটকা সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশে মিডিয়ার ভূমিকাও প্রশংসনীয়।[লেখক : গবেষক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট]yahiamahmud@yahoo.com